ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ন্যান্দার লাশ বহনের ৩০ বছর

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৬ অক্টোবর ২০১৮

  ন্যান্দার লাশ বহনের ৩০ বছর

ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে রিক্সা চালাতাম। প্রায়ই হাসপাতালের মূল গেটে রিক্সা নিয়ে যাত্রীর জন্য বসে থাকতাম। হঠাৎ একদিন ওই হাসপাতালে একজন রোগী মারা যায়। মরদেহটি বহন করে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বজনরা অনেক অনুরোধ করেও একটি ভ্যান বা রিক্সা জোগাড় করতে পারেননি। ভয়ে কেউ লাশ বহন করতে চাইত না। প্রথমে আমিও পারব না বলেছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবেই ঘটনাটি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। নিজের কাছে নিজেই কষ্ট পেলাম। না সব চিন্তা চেতনা ভয়ডর দূর করে সাহস করে বললাম, আমি লাশ নিয়ে যাব। মৃত রোগীর স্বজনরা যেন আমার কথায় প্রাণ ফিরে পেল। আমি ওই লাশটি জেলা শহর হতে ১৫ কিলোমিটার অদূরে ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে লাশসহ ভ্যানটি কচুকাটা ইউনিয়নের কামারপাড়া এলাকায় তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঠিক এভাবে ৩০ বছর আগের জীবনে প্রথম লাশ বহন করার স্মৃতি তুলে ধরলেন ইসমাইল হোসেন ওরফে ন্যান্দা। তার বয়স প্রায় ৬৫ বছরের কাছাকাছি। এই বয়সেও এখনও ছুটে যান বেওয়ারিশ কিংবা ট্রেনে কাটা টুকরো লাশ বহন করতে। নীলফামারী পৌরসভা এলাকার কুখাপাড়া (ধনীপাড়া) মহল্লার বাসিন্দা সে। মাত্র তিন শতাংশ জমির ওপর বসতভিটা তার। আট সন্তানের জনক। ছয় ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ ১০ সদস্যের পরিবার। অতি কষ্টে মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে বিবাহিত, তিনি নিজের সংসার নিয়ে আলাদা। সংসারে সারা বছর অভাব-অনটন লেগেই আছে। তারপরও ছাড়েননি এই পেশা। জেলার সৈয়দপুর রেলওয়ে (জিআরপি) থানার পুলিশ এবং জেলা সদর থানার পুলিশের কাছে লাশ বহনের এক নাম ন্যান্দা। থেকে সৈয়দপুর রেলস্টেশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বা কোন দুর্ঘটনা আত্মহত্যা বা হত্যার ঘটনায় লাশবহনে ডাক পড়ে তার। এছাড়াও পুকুরে ডুবে মৃত্যু, কবর থেকে উঠানো গলিত লাশ বহন করা তার কাছে কঠিন কোন কাজ নয়। ঘটনাস্থল থেকে ভ্যানে লাশ নিয়ে ছুটে যেতে হয় সদর হাসপাতাল মর্গে। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে জেলা শহর থেকে দূর-দূরন্তে, গ্রামগঞ্জে রাতের আঁধারে গিয়েও স্বজনদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হয় মৃতদেহ। আবার বেওয়ারিশ লাশ হলে তার দাফনের কাজটিও করতে হয় তাকেই। বিনিময়ে পেয়ে থাকেন মজুরী। এভাবে এলাকায় দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লাশ টানছেন ন্যান্দা। জীবন-জীবিকার যুদ্ধে এই বিচিত্র পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। এ যুদ্ধে কখনও হার মানেননি। ন্যান্দার স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, প্রথম প্রথম বাড়ির ছেলেমেয়েরা তার ধারে-কাছে যেত না। এমনকি তার কাছে যেতে আমিও ভয় পেতাম। কোন কোন সময় স্বজনদের বাড়িতে লাশ পৌঁছে দিয়ে ভোরবেলা বাড়িতে ফিরত। এখন আর এটা নিয়ে পরিবারের কেউ কিছু বলে না। বরং কাজটি মহৎ ও সেবামূলক বলে মনে করে সবাই। ন্যান্দা বলেন, ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে রিক্সা চালাতাম। এখন লাশ বহন করে সংসার চালাই। আজ পর্যন্ত একাধারে লাশ বহনের কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। এ পর্যন্ত কতগুলো লাশ বহন করেছেন ন্যান্দা তার হিসাবও রাখেননি। তবে ৩০ বছরে এক হাজারটা পার হবে বলে তার ধারণা। এ কাজে শুরুর দিকে মনের মাঝে ভয়ভীতি থাকলেও এখন সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হয় তার কাছে। তিনি আরও জানান, সময় মতো লাশ মর্গে নিতে না পারলে সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। আবার ময়নাতদন্তের চিকিৎসক সময়মতো না থাকায় অনেক সময় মর্গে লাশ পাহারায় থাকতে হয়। লাশবাহী ভ্যানটিতে শুধু লাশ বহন ছাড়া সাধারণ যাত্রী উঠতে চায় না । কারণ, তিনিও জানেন এই ভ্যানে সাধারণ যাত্রী উঠবে না। তাই অনেক সময় অলস হয়ে বসে থাকতে হয়। নতুন রিক্সা কেনার সামর্থ্য নেই তার। তবু লাশ টানার পেশা ছাড়েননি তিনি। মাসে কত টাকা আয় হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন স্বজনরা হয়ে যায় অসহায়। তাই লাশ বহনে দরকষাকষি না করে মানুষ খুশি মনে যা দেয়, সেটা নিয়ে আমিও খুশি থাকি। তবে, এতে দেখা যায় প্রতি মাসে গড়ে আয় হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা। এই অর্থ দিয়ে কোন রকমে চলছে জীবন। ন্যান্দার কাছে এটি একটি মহৎ পেশা। তিনি বলেন, সব মানুষকে কবরে যেতে হবে। এটা ভেবেই আজও লাশ টানছেন তিনি। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×