স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ জয় এবং আনন্দ-উদ্যাপন... এ দুটো একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৫ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল এখন এই দুটো একসঙ্গে গেঁথে ফেলার দ্বারপ্রান্তে। এ জন্য তাদের হারাতে হবে ভারতকে। কমলাপুর স্টেডিয়ামে রবিবার দুপুর আড়াইটায় সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অবশ্য বাংলাদেশই ফেভারিট। কিন্তু ফেভারিট হলেও মাঠে আসল কাজটা করতেই হবে। তা না হলে আনন্দ উদ্যাপন করার উপলক্ষ মাঠেই মারা যাবে।
ফাইনালের আগে নিজেদের ঝালিয়ে নিতে দুদিন সময় পাচ্ছে ‘বেঙ্গল টাইগ্রেস’ দল। বাফুফের আর্টিফিসিয়াল টার্ফে তারা অনুশীলনে ঘাম ঝরাচ্ছে সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু এবং হেড কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের অধীনে।
জয়ের আনন্দ সবসময়ই মধুর, তা সেটা যে কোন পর্যায়ের জয়ই হোক না কেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ফুটবলে ভারত সবসময়ই সেরা দল। তাদের সিনিয়র দলকে আজও হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলের চিত্রটাও ছিল একই রকম। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে সেটা বদলে যায় আমূল। এখন বাংলাদেশই ভারতকে হারায় নিয়মিত, এই যেমন সর্বশেষ হারালো ৩-০ গোলে, বৃহস্পতিবার, কমলাপুর স্টেডিয়ামে, সাফ অ-১৫ মহিলা চাম্পিয়নশিপে।
২০১৫ সালে এএফসি অনুর্ধ-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে দুবার হারিয়েছিল বাংলাদেশ। গ্রুপপর্বে ৩-১ এবং ফাইনালে ৪-০ গোলে। এবারও হারিয়ে তাদের হ্যাটট্রিক তেতো হারের স্বাদ উপহার দিল লাল-সবুজরা।
এক ম্যাচ হাতে রেখে আগেই ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেছিল বাংলাদেশ-ভারত। তাই বৃহস্পতিবার এই ম্যাচের কোন গুরুত্ব ছিল না। এটা ছিল রাউন্ড রবিন লীগে উভয় দলেরই তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ। তারপরও দুই দলের কাছে ম্যাচটি ছিল মর্যাদার। যাতে জয়ী হয় ছোটনের শিষ্যারা।
বৃহস্পতিবার ভারতকে হারানোর পর কতটা উল্লাস করেছিল বাংলাদেশ দল? ফাইনালের আগে কতটা সিরিয়াস তারা? জানতে চাওয়া হয় দলের অধিনায়ক-মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দা, সহ-অধিনায়ক ও ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন এবং এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার মনিকা চাকমার কাছে। বিস্ময়করভাবে তারা প্রায় একই ধরনের উত্তর দিয়েছে।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের মেয়ে মারিয়া মান্দা। আজ থেকে চার বছর আগেও একজোড়া বুট কেনার সামর্থ্য ছিল না তার। স্কুল শিক্ষকরা বললেন, যারা খেলতে চাও তাদের বুট কিনতে হবে। কিন্তু মারিয়ার বুট কেনার মতো পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য নেই। তার বাবা বীরেন্দ্র মারাক আগেই মারা গেছেন। মা এনতা মান্দা গৃহকর্মীর কাজ করেন। মাঝে মাঝে দিনমজুরিও করেন। নিজের জমিজমা নেই, অন্যের জমিতে ধানের চারা লাগান। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় গ্রামের রাস্তায় মাটিও কাটেন। শ্রমিকের কাজ করে ডাল-ভাত খেয়ে না খেয়ে কষ্টে সংসার চালান। ক্ষুদে মারিয়ার ফুটবল খেলার স্বপ্ন পূরণে তার মা তিনদিন শ্রমিকের কাজ করেন। সেই টাকা দিয়ে বুট কিনে খেলায় অংশ নেয় মারিয়া।
সেই মারিয়া এখন সময়ের পরিক্রমায় অ-১৫ দলের অধিনায়ক। রবিবারের ফাইনাল নিয়ে তার ভাষ্য, ‘ফাইনাল এখনও বাকি। তাই এখনই কোন আনন্দ নয়। এখনও আমাদের খেলার উন্নতির আরও অবকাশ আছে। আগের মাচগুলোতে যেসব ভুল হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কোচ ছোটন স্যার কাজ করছেন। সব ভুল শুধরে সবাই ফাইনালে জিততে চাই। ভারতকে হারিয়ে আমাদের সবার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। দর্শকরা যদি সবাই স্টেডিয়ামে আসে আর আমাদের সাপোর্ট করে তাহলে অবশ্যই ভাল খেলব এবং চ্যাম্পিয়ন হব। সেলিব্রেশন করবো চ্যাম্পিয়ন হবার পর।’ চলমান আসরে ভুটানকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। ম্যাচের প্রথম দুটি গোলই আঁখির। অথচ তার পজিশন ডিফেন্ডার। প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হয় বিকেএসপির নবম শ্রেণীর এই শিক্ষার্থী। আঁখি এখন দেশের বয়সভিত্তিক ফুটবলে অটোমেটিক চয়েস। তীক্ষè মেধায় সামলায় রক্ষণদেয়াল, যেভাবে সামলেছে নিন্দুকদের।
গড়নে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় আঁখি পায় বাড়তি সুবিধা। লম্বা ফ্রি-কিকেও পারদর্শী। ডিফেন্স থেকে ওপরে উঠে যেভাবে গোল করে তা দেখে ইতালির পাওলো মালদিনি আর বাংলাদেশের কায়সার হামিদের কথা মনে পড়ে যায়। ফাইনাল প্রসঙ্গে আঁখির অভিমত, ‘এখনও খেলা শেষ হয়নি। তাই লীগ ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে আমরা কোন রকম আনন্দ-ফূর্তি করিনি। গত তিনটি ম্যাচ যেভাবে খেলেছি, ফাইনালেও সেভাবেই খেলে জিততে চাই। আশাকরি দেশবাসীর দোয়া ও সমর্থন থাকলে আমরা বিজয়ী হব।’ সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে এ নিয়ে দু’বার ম্যাচসেরা হলো মেসিভক্ত মনিকা। প্রথমবার হয় নেপালকে হারানোর ম্যাচে। দ্বিতীয়বার ভারতকে হারানোর ম্যাচে। দুটো ম্যাচেই একটি করে গোল করে সে। ফাইনাল নিয়ে মনিকার সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘এর আগে ভারতকে তিনবার হারিয়েছি। এবারও তাদের ফাইনালে হারাতে চাই।’