ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রণালয়ের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নারী শিক্ষার স্বপ্নভূমি স্থাপন

শিক্ষাঙ্গনের খালি জায়গা সবুজ-সুন্দর হতে যাচ্ছে গাছে গাছে

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

শিক্ষাঙ্গনের খালি জায়গা সবুজ-সুন্দর হতে যাচ্ছে গাছে গাছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছে দুটি বিশেষ প্রকল্প। যার একটির মাধ্যমে বিপন্ন হতে যাওয়া সব গাছে সবুজ হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাঙ্গন সবুজ ও সুন্দর রাখতে প্রতিষ্ঠানের খালি জায়গায় বিপন্ন ১০ প্রজাতির গাছ লাগানো হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলাও এই কার্যক্রমের একটি লক্ষ্য। আর অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ছয় মহীয়সী নারীর স্বপ্নপূরণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘নারী শিক্ষার স্বপ্নভূমি স্থাপন’ নামে প্রকল্পের আওতায় ছয় মহীয়সী নারীর নামে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করে ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বাড়াতে দেয়া হবে প্রশিক্ষণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, অন্য যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে কিংবা আরও যেসব পরিকল্পনা আছে তার তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের এ দুুটি প্রকল্প। সরাসরি শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত না হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগ। বিপন্ন গাছ লাগানোর উদ্যোগের বিষয়ে জানা গেছে, শিক্ষাঙ্গন সবুজ ও সুন্দর রাখতে প্রতিষ্ঠানের খালি জায়গায় বিপন্ন গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিলুপ্তপ্রায় গাছ সংরক্ষণে দেশের সব সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় বিপন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হবে বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. মোহম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেছেন, প্রতিনিয়ত দেশ থেকে গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও গাছ-গাছালিরও অভাব রয়েছে। এই দুইটি বিষয়েই মিলন ঘটনো হবে প্রকল্পটির মাধ্যমে। এতে বিলুপ্ত গাছও সংরক্ষণ হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সবুজ হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে। সংবিধানের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচীর ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে উৎসাহী হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এই কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে বলে বলছেন এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হারিয়ে যাওয়া গাছ সংরক্ষণ ও শিক্ষাঙ্গনের আঙিনা সুন্দর রাখাও প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। এসবের ওপর ভিত্তি করেই প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছে ‘সবুজ শিক্ষাঙ্গন বিনির্মাণে বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণ’। কার্যক্রমটি আগামী বছরের জানুয়ারি থেকেই শুরু করার আশা সরকারের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ছয় হাজার প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে এক হাজার প্রজাতির গাছ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফুল ও ফল দেয়, এমন বিলুপ্তপ্রায় গাছ রয়েছে ২৫। এর মধ্যে এ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ১০ প্রজাতির ফল দেয়া গাছ বেছে নিয়েছেন, যা প্রথম অবস্থায় দেশের ৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগানো হবে। সরকারের লক্ষ্য দেশের ১০ অঞ্চলের ১০ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ দশটি কলেজে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে বিপন্ন গাছের চারা উৎপাদন করা হবে। ওই ১০ কলেজে গাছ উৎপাদনের জন্য ১০ ল্যাব করা হবে। সেখানে বিশেষজ্ঞ টিমও থাকবে। পরবর্তী সময়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় ওই গাছ লাগানো হবে। টিস্যু কালচার করার জন্য ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ ও সরকারী বাঙলা কলেজ, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর ও বরিশাল অঞ্চলের মোট ১০ বড় কলেজকে নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে রয়েছেন মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপ-পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন, ফোকাল পয়েন্টে আছেন সহকারী পরিচালক মিনহাজ উদ্দীন আহম্মদ এবং সহায়তাকারী হিসেবে রয়েছেন গবেষণা কর্মকর্তা আজিম কবীর। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খালি জায়গাগুলোতে গাছ লাগানো হবে। আবার প্রকল্পটি কেবল গাছ লাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর পরিচর্যা করার জন্যেও প্রণোদনা দেবে সরকার। প্রকল্প শেষ হলেও যেন গাছগুলো পরিচর্যা পায়, সে বিষয়েও পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে অপর ব্যতিক্রমী প্রকল্পের নাম হচ্ছে ‘নারী শিক্ষার স্বপ্নভূমি স্থাপন’। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলছিলেন, আসলে দেশের ছয় মহীয়সী নারীর স্বপ্নপূরণে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটি যুগান্তকারী একটি উদ্যোগ। তিনি বলেন, নারীর উন্নয়ন ও তাদের অধিকার শতভাগ নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রয়োগসহ নানামুখী কার্যক্রম থাকার পরও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার থেকে রেহাই পাচ্ছেন ছাত্রীসহ নারীরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর আলোকে নারীদের শিক্ষা ও জ্ঞানের সমৃদ্ধির জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বেগম রোকেয়া, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বেগম সুফিয়া কামাল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী এবং সারদা সুন্দরী এই ছয় মহীয়সী নারীর নামে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করে ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকাণ্ডের বাইরে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীদের জন্য থাকবে আলাদা প্রশিক্ষণ। পরিচালক বলছেন, এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী শিক্ষার যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। ২০১৮ সাল থেকেই এর কার্যক্রম শুরু করতে চান কর্মকর্তারা। প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ওই ছয় মহীয়সী নারীর নামে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোকে নারী শিক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে, দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি নারী। এ অবস্থায় নারীর উন্নয়ন ছাড়া দেশে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার নারী এখনও নিরাপদ নয়। তাই নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান নারী নিজেই করতে পারবে। নির্যাতনের শিকার নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক সেবা ও আইন সেবা দিলেই দীর্ঘমেয়াদে সুফল ভোগ করবে সমাজ। প্রকল্পের উদ্দেশ্য দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথম বিষয়টি হচ্ছেÑ নারী শিক্ষার্থীদের সুস্থ শারীরিক গঠন, মনের বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে এক নারী শিক্ষার্থী যেন তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আগামীদিনের যোগ্য নাগরিক, যোগ্য মাতা হিসেবে জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারেন। প্রকল্পের দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে মহীয়সী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাদের ইচ্ছাকে মর্যাদা দেয়া ও তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ। জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান ও মিটিংয়ের জন্য অডিটোরিয়াম, খেলাধুলার সামগ্রী এবং কনফারেন্স রুমও তৈরি করা হবে। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানগুলোয় নারীবান্ধব শিক্ষা কমপ্লেক্স, অডিটরিয়াম, একাডেমিক ভবন ও আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া, লাইফ স্কিল ট্রেনিং বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শকের সাহায্যে প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি, লাইফ স্কিল ট্রেনিংয়ের জন্য দক্ষ মানবশক্তি, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও মহীয়সী নারীদের স্মৃতি সংরক্ষণ কর্নার, ল্যাঙ্গুয়েজ ও আইটিসি ল্যাব, কাউন্সেলিং কর্নার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, ইনডোর গেমস ও রিক্রিয়েশন রুম, যাতায়াতের সুবিধাসহ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও নির্মাণ নিশ্চিত করা হবে। জানা গেছে, এরই মধ্যে নবাব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারী কলেজ, পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারী বেগম রোকেয়া কলেজ, সরকারী সারদা সুন্দরী মহিলা সরকারী কলেজ ও সারদা সুন্দরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
×