পাল বংশের রাজাত্বকাল এ বাংলায় কাঁসা-পিতল-তামাশিল্প উৎকর্ষতায় পৌঁছে- একটা সময় ছিল যখন বাংলার গ্রামজুড়ে কামারের সৃষ্ট আওয়াজের ছন্দে তামা- -কাঁসা-পিতলে এক বিস্তীর্ণ ইতিহাস সৃষ্টি হতো, তৈজস্ব উৎপাদন থেকে শুরু করে তৈরি হতো নিখুঁত নকশার সব ভাস্কর্য। তামা, পিতল মৌলিক আর কাঁসা একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ। বাংলাদেশে এই ধাতুশিল্প কখন, কোথায় শুরু হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে প্রতœতাত্ত্বিকদের মতে এটি প্রাচীন আমলের সভ্যতায় শুরু, যখন ব্রোঞ্জশিল্প ছিল। আবার অনেকেই এই শিল্পকে পাহাড়পুর-মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন। অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পীর ধারণা তামা-পিতল-কাঁসাশিল্প রামায়ণ-মহাভারত যুগের। রামায়ণ-মহাভারতের যুগে জীবনচর্চায়, পূজা-পার্বণে তামা-পিতল-কাঁসার তৈরি ঘটি-বাটি ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার হতো। কালের বিবর্তনে পিতল সামগ্রীর ব্যবহারের মাত্রা দিন দিন কমে গেলেও সৌখিন মানুষের কাছে এর চাহিদা রয়ে গেছে বৈকি! অন্দরসজ্জার উপকরণ হিসেবেও ইদানীং ঘরে শোভা পাচ্ছে পিতলের সামগ্রী। এসবের মধ্যে রয়েছে নানারকম শো-পিস, ওয়ালম্যাট, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গ্লাস, থালা, বাটি, কাজলদানি, চামচ, হুক্কা, আয়নার ফ্রেম ইত্যাদি। তামা-কাঁসা-পিতল শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এন্টিক ব্যবসা। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত সত্যিকারের এন্টিক-ই কেনাবেচা হতো ধামরাইয়ে।
এন্টিক যখন শেষ হয়ে যেতে থাকল, তখন এন্টিকের মতো (কপি) ভাস্কর্য তৈরি করে বিক্রি করার আগ্রহ থেকে ১৯৮০-এর দশকে প্রথম এখানে তামা-কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু হয়। যে পদ্ধতিতে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়, বাংলাদেশে তা নতুন হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে তা নতুন নয়। বরং কয়েক হাজার বছরের পুরনো, সুপ্রাচীন হরিশচন্দ্র্র পালের বিহারে খনন করে কয়েকটি তামা-পিতলের মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। সুতরাং সেই পাল আমল থেকেই যে এখানে তামা-পিতলের শিল্প গড়ে উঠেছে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কাঁসা-তামা-পিতলে শুধু বাসন-কোসনই নয়, এই তামা-কাঁসা-পিতলে তৈরি হতে পারে নিখুঁত সব ভাস্কর্য। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই শিল্পের চাহিদাও আছে ব্যাপক। অথচ শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে এই শিল্প এখনও পড়ে আছে দেশের এক নিভৃত কোনে।
ভারতে এ ধরনের মূর্তি তৈরি হলেও তাদের অতি বাণিজ্যিক উৎপাদন পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্যগুলো আমাদের দেশের ভাস্কর্যগুলোর মতো এতটা নিখুঁত হয় না। প্রাচীন জিনিসপত্র ও ভাস্কর্য দেখে ধামরাইয়ের শিল্পীরা প্রথমে কাঁসা দিয়ে নানা ধরনের ভাস্কর্য বানায়। এরপর পিতল ও তামার ব্যবহার শুরু করে। এখন পর্যন্ত কাঁসা-তামা-পিতল দিয়ে ছোট বড় ভাস্কর্য ধামরাইতে বানানো হচ্ছে।
রথ যাত্রার ওপরও বড় ভাস্কর্য বানিয়েছে ধামরাইয়ের কাঁসা শিল্পীরা। কাঁসা-পিতল-তামার তৈজসপত্রসহ নানা ধরনের শো পিস বানানো শুরু হয়। টাঙ্গাইল, ধামরাই, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, পাবনা এলাকা ছিল কাঁসার জিনিসপত্রের অন্যতম এলাকা। সাধারণত কেজি কিংবা সের হিসেবে এসব পণ্য বিক্রি হয়। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে তামা, ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে কাঁসা এবং ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে পিতলের তৈরি পণ্যসামগ্রী।