ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৬ কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের যৌথ লেখায় স্বীকৃতি ;###;ক্ষতি হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতায় ;###;বাল্যবিবাহ স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও যৌন নির্যাতনের কারণ

বিস্ময়কর অগ্রগতি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৮ মার্চ ২০১৭

বিস্ময়কর অগ্রগতি

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মেয়েশিশু ও নারীর জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ দারুণ অগ্রগতি সাধন করেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন ঢাকায় অবস্থিত ১৬ কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা। তারা আরও বলেছেন, দেশের নীতিমালা ও কর্মসূচীর জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা ও স্থান অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করা গেলে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিরই আরও প্রসার ঘটাবে। ঢাকায় ১৬টি কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের ফোরাম ‘এ্যাম্বাসেডর্স ফর চেঞ্জ’ এবারের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে অভিমত প্রকাশ করেছে। ‘নারীর প্রতি সহিংসতার অর্থনৈতিক প্রভাব’ শিরোনামে এই লেখাটি ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো হয়েছে। এতে তারা বলেছেন, নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে যেসব ক্ষতি সাধিত হয় তা সামাল দেয়া যে কোন দেশের জন্যই কঠিন। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে যে ক্ষতি হয় তা এ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের আনুমানিক ২ দশমিক ১ শতাংশ। সহিংসতা প্রতিদিন একটি মেয়েকে বিদ্যালয়ে যেতে এবং একজন নারীকে চাকরি করতে বাধা দেয়। আর এর ফলে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে তাদের আপস করতে হয় এবং একটি গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। যারা সহিংসতার শিকার তারা জীবনে শারীরিক ও মানসিক ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকে এবং সামাজিক ও আইনী সহায়তাকে সংগ্রাম করতে হয় তাদের সাহায্য করার জন্য। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা যদি অমূল্য সম্ভাবনা হিসেবে অর্থনীতিতে অবদান না রাখতে পারে তাহলে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের দিকে বাংলাদেশ কি তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারবে? নারী ও পুরুষে সমতা অর্জন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে একটি। মেয়েশিশু ও নারীর জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ দারুণ অগ্রগতি সাধন করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ভর্তি করছে। মা ও শিশু মৃত্যুহার অনেকাংশে কমেছে এবং নারীরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মেরুদ- তৈরি করছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রফতানি ক্ষেত্র তৈরি পোশাক খাত চল্লিশ লাখ বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান করেছে, যাদের বেশিরভাগই নারী। ক্ষেত্রটিতে নারীর অংশগ্রহণের হার কমছে। যাই হোক, শিল্পটি যেহেতু কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে দেশের নীতিমালা ও কর্মসূচীর জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা ও স্থান অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। ক্ষুদ্র ঋণের সৃষ্টি ও প্রসারে যেখানে অগ্রাধিকার দেয়া হয় নারী উদ্যোক্তাকে যা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে এবং বৈশ্বিক সমৃদ্ধিতে এই ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান। নারীর প্রতি সহিংসতা এই অগ্রগতিকে রুখে দেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮০ শতাংশেরও বেশি বিবাহিত নারী তার জীবদ্দশায় কমপক্ষে একবার নির্যাতনের শিকার হয়; তা সে শারীরিক, যৌন, মানসিক বা আর্থিক অথবা আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ, যাই হোক না কেন। গত এক বছরে আনুমানিক দুই-তৃতীয়াংশ বিবাহিত নারী তার স্বামীর দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানা গেছে। বাল্যবিবাহ এবং মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেয়ার যে উচ্চ হার রয়েছে বাংলাদেশে তা লাখ লাখ মেয়েকে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। আর এসব নির্যাতনের যারা শিকার তার মধ্যে খুব কমই এসব ঘটনার অভিযোগ দাখিল করে থাকে। কারণ, বাংলাদেশী আইন তাদের যেসব অধিকার দিয়েছে সেসব অধিকারের কথা তারা জানে না। অথবা তারা প্রতিশোধ, দুর্নামের ভয় পায় বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য পায় না বলে তাদের কাছে যায় না। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হবার ভয় অথবা রাস্তাঘাটে চলাফেরার সীমাবদ্ধতা নারীর উপার্জন করার সুযোগ-সুবিধা সীমিত করে দেয়। যেসব কর্মজীবী নারী বাসগৃহে সহিংসতার শিকার হয় কাজ থেকে বাধ্য হয় দূরে থাকার। এ কারণে তাদের আয়-রোজগার কমে আসে এবং অনেকক্ষেত্রে চাকরিতে যেতেও পারে না। নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করা গেলে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আরও প্রসার ঘটাবে। নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান ন্যায় আর অন্যায়ের মতো সরল একটা বিষয়; একটি অহিংস সমাজ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে নারী ও মেয়েশিশু যেন কোন প্রকার নির্যাতন আর সহিংসতার ভয় ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে এমন সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আর তা শুধু নারী ও মেয়েশিশুর জন্যই নয়, পুরুষ ও ছেলেশিশুর বেলায়ও তা নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতার চক্রের অবসান ঘটানোর জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং সবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। পরিবর্তন শুরু হতে পারে স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমেও। একটি উদাহরণ হচ্ছে ‘সখি’ প্রকল্প Ñনেদারল্যান্ডস দূতাবাসের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ উইমেন্স হেলথ কোয়ালিশন, মেরি স্টোপস বাংলাদেশ এবং উই ক্যান বাংলাদেশের যৌথ সমন্বয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি ঢাকার পনেরোটি বস্তির নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়; কিভাবে তাদের পরিবারের জন্য আয় করতে হবে, তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয় চাকরি মেলার মাধ্যমে সম্ভাব্য চাকরিদাতার সঙ্গে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে। কক্সবাজার জেলায় ঝুঁকির মুখে রয়েছে এমন নারীদের জীবিকা উন্নয়নে বিশ্ব খাদ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএফপি) সহায়তা করছে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য। সেখানে স্বনির্ভর নারীগোষ্ঠী ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলছে জমা টাকা দিয়ে, যেখানে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী অবদান রাখছে তাদের সঞ্চয় দিয়ে এবং প্রত্যেক নারী সম্পদ কিনতে পারছে ও উদ্যোক্তা হবার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পারছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে ও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মনোভাবের পরিবর্তন এবং অর্থনীতির মৌলিক বিষয়াবলী ও প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনাই হবে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের ফর্মুলার প্রধান অংশ। নারী ও মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিতকরণ এই পরিবর্তনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নারীর প্রতি সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করা, একে সহ্য না করা এবং যারা এই ধরনের সহিংসতার শিকার তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মতো সাধারণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যেকেই এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারি। আমরা এ্যাম্বাসেডর্স ফর চেঞ্জে যারা প্রতিনিধিত্ব করছি অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এবং ইউএন উইমেন, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর (ডব্লিউএফপি); আমরা আপনাদের প্রত্যেককে আহ্বান করছি আমাদের পাশে দাঁড়াতে। আমরা আপনাদের আহ্বান করছি আমাদের বাংলাদেশী বোনদের, পুরুষ সহকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর যাতে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আমরা নির্মূল করতে পারি। নারী দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে এই লেখাটি লিখেছেন বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জুলিয়া নিবেট, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত ওয়ানজা ক্যাম্পোস দ্য নোব্রেগা, ব্রুনাইয়ের হাইকমিশনার হাজাহ মাসুরেই বিন্তি হাজি মার্সি, কানাডার হাইকমিশনার বেনওয়া পিয়েরে লারামে, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সোফি অবেয়ার, মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার নুর আশিকিন মোহাম্মাদ তায়েব, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি মারগারেথা কুলেনারে, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লেকেন, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত ইয়াসোজা গুনাসেকেরা, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ইয়োহান ফ্রিজেল, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার এলিসন ব্লেইক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, ইউএসএআইডি বাংলাদেশের মিশন ডিরেক্টর ইয়ানিনা জারুজেলস্কি, ইউএন উইমেন কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্রিস্টিন হান্টার, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ লরি কাটো ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডব্লিউএফপি) কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টা রাডার।
×