ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

গণমাধ্যমে তেমন প্রচার চালানো হয় না ॥ দায়সারা কাজ করেন মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা

সরকারি প্রণোদনায় উপেক্ষিত প্রকৃত শিক্ষার্থীরা

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ১১ মে ২০২৫

সরকারি প্রণোদনায় উপেক্ষিত প্রকৃত শিক্ষার্থীরা

সরকারি প্রণোদনায় উপেক্ষিত প্রকৃত শিক্ষার্থীরা

গরিব অসচ্ছল শিক্ষার্থী-শিক্ষক, দুর্বল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে নানা উদ্যোগ। একাধিক প্রকল্প এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ও সরকারের সরাসরি অর্থ বরাদ্দ আছে শিক্ষা উন্নয়নে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাব ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় ও দুর্বল ব্যবস্থাপনায় এসব অর্থের সৎ ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু এই অর্থের সঠিক ব্যবহার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন পাল্টে দিতে পারত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কতিপয় স্কুলের প্রধানদের সম্পর্ক ভালো।

যে কারণে সরকারি অর্থ সাহায্যের খবর শুধু তারাই জানতে পারে। এ ছাড়াও মাঠপর্যায়ের শিক্ষাপ্রশাসনের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যও জড়িত অনেকে। ফলে দেশী-বিদেশী এসব অর্থায়ন প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে টাকা সরবরাহ করতে পারছে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সম্প্রতি মাই গভ ওয়েব সাইট থেকে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ৮ হাজার টাকা, শিক্ষক প্রতি ৩০ হাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হবে। এই অনুদানের আবেদন এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন চলছে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। তবে অনেক শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এ বিষয়ে তেমন জানতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিতে যোগাযোগ করা হয় মাগুরা জেলা শিক্ষা অফিসে। এই অফিসের কর্মকর্তারা জানান, মাগুরায় চারটি উপজেলা থাকলেও মাত্র একটি উপজেলার তিনটি স্কুল থেকে অর্থপ্রাপ্তির জন্য আবেদন জমা পড়েছে। স্কুলগুলোর নাম হচ্ছে আমতৈল উচ্চ বিদ্যালয়, খামারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও খামারপাড়া বিদ্যালয়। কিন্তু বাকি তিন উপজেলা থেকে কোনো আবেদন আসেনি।
মাঠপর্যায়ে জড়িত একাডেমিক সুপারভাইজার আব্দুল মাজেদ এর ব্যখ্যায় জনকণ্ঠকে জানান, জেলা থেকে ২৩৬ শিক্ষার্থী এই অর্থ পেতে আবেদন করেছে। শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ১৫ জন। এর সঙ্গে ব্যাপক প্রচারণার অভাব যে রয়েছে তা তিনি স্বীকার করেন।
এদিকে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস জানাচ্ছে, জেলায় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান থাকার পরও মাত্র ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই অর্থ পেতে আবেদন করেছে। শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদনের সংখ্যা ৬০টি। তবে বেশি আবেদন জমা পড়েছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। জেলায় ২৭০০ শিক্ষার্থী নগদ অর্থের জন্য আবেদন করেছে।
সূত্র বলছে, আগে এই অর্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হলেও এবার তা মাই গভ থেকে ছাড় করা হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্ব স্ব ব্যংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে। কিসের ভিত্তিতে টাকাগুলো দেওয়া হবে জানতে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার ও এই কমিটির সদস্য সচিব মো. আব্দুল মজিদ জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষর্থীদের ক্ষেত্রে অসচ্ছল, মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

শিক্ষক-কর্মচারী যারা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, অসচ্ছল তাদেরকে এই অর্থ প্রদানে বিবেচনা করা হবে। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল সংকট, ভালো বেঞ্চ নেই, অবকাঠামোর অবস্থা খুবই খারাপ তারাও যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এ ছাড়াও প্রত্যন্ত ও চর অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এই তালিকায় এগিয়ে রাখা হবে।
ঢাকা বিভাগীয় শিক্ষা অফিস বলছে, বিভিন্ন গ্রুপ করে এই অর্থ দেওয়া হবে। একটি উপজেলায় ক্লাস ৬-৮ পর্যন্ত একটি গ্রুপ করা হয়েছে।  এই গ্রুপের মোট ৪ শিক্ষার্থী অর্থ বরাদ্দ পাবে। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা রয়েছে আরেক দলে। তাদের থেকে তিনজনকে টাকা দেওয়া হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী ও তদূর্ধ্ব আরও দুই শিক্ষার্থী এই সহায়তার আওতায় আসবে। প্রতিটি জেলা থেকে তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নগদ এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। আর শিক্ষক-কর্মচারী পাবেন মোট ৪ জন।

এখন অফিসগুলোতে দীর্ঘ সময় আবেদনের পর এখন যাচাই-বাছাই চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি স্কিমের নাম পারফর্মেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস (পিবিজিএসআই)। হাজার কোটি টাকার বেশি এই স্কিমের জন্য রয়েছে বিশাল অর্থ সহায়তা। গত বছর প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে এই স্কিমের আওতায় নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এসএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পেয়েছেন ১০ হাজার টাকা।

এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও প্রতিটি উপজেলায় একজন পুরুষ শিক্ষককে ১ লাখ ও একজন নারী শিক্ষককে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও হাজারো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে নগদ ৫ লাখ টাকা। অর্থ দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ ছিল। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার ৫ লাখ টাকা পেয়ে কোনো উন্নয়ন না করেই নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে বলে সমালোচনাও উঠে। 
এই স্কিমের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিটি উপজেলায় ইউএনও সভাপতি ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সদস্য সচিব থাকেন। তারাই এসব বিষয়গুলো চূড়ান্ত করেন। এসব নির্বাচন যে ত্রুটিযুক্ত ছিল সেটিও তিনি স্বীকার করেন। এবার ত্রুটিমুক্ত করতে জোরোশোরে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, এতিম শিক্ষার্থী, ভূমিহীন পরিবারের সন্তান, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা সন্তানের সন্তান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুস্থ পরিবারের সন্তান ভর্তির আর্থিক সহায়তায় অগ্রাধিকার দেয় শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট। যা আগে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট নামে পরিচিত ছিল।

বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫ হাজার টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮ হাজার টাকা এবং ¯œাতক ও সমমান পর্যায়ে ১০ হাজার টাকা হারে এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেসামরিক সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ‘জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫’ অনুযায়ী ১৩ থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারীর সন্তান আর্থিক এ অনুদান প্রাপ্তির যোগ্য বিবেচিত হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে পিতা, মাতা, অভিভাবকের বার্ষিক আয় ২ লাখ টাকার কম হতে হবে।

মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীই প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে অর্থ সহায়তা পাবে না। শুধু যারা এ শর্তের মধ্যে পড়বেন, আবেদন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে তাদের সহায়তা করা হবে।  এ বিষয়েও মাঠ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তেমন জানাশোনা নেই বলে শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান। অনলাইনে আবেদন, দিনক্ষণ কবে এসব তেমন সামনে না আসায় অনেক প্রত্যাশী আবেদনে ব্যর্থ হয়।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ব্রাক বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রণোদনাজনিত সমস্যা আগেও ছিল এখনো আছে। আগেও নির্বাচনী ত্রুটি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা দেখা যেত। এখনো এর বেশি পরিবর্তন আসেনি। এ বিষয়ে শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ ছাড়াও এখন শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ শুধু প্রণোদনা দিয়েই শিক্ষার উন্নতি হবে না।

×