ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গত বছর ই-কমার্স সেক্টরে হাজার কোটি টাকার লেনদেন

অনলাইন ব্যবসায় নারী ॥ প্রায় ৫ হাজার ফেসবুক পেজ এখন নারী উদ্যোক্তাদের

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অনলাইন ব্যবসায় নারী ॥ প্রায় ৫ হাজার ফেসবুক পেজ এখন নারী উদ্যোক্তাদের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ আয়েশা আক্তার। ছাত্রজীবন থেকেই তার ইচ্ছা ছিল ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করার পর আয়েশা দীর্ঘ পাঁচ বছর একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিলেও নিজেকে গুটিয়ে রাখেননি। ই-কমার্সের মাধ্যমে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বড় চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন তিনি। প্রথমে ছোট আকারে হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসা শুরু করে নিজেকে ঝালিয়ে নেন আয়েশা। এরপর বড় আকারে অনলাইন শপিং সাইটে শুরু করেন ‘কাইট হাট’। ক্রেতাদের কাছাকাছি যেতে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্যের সম্ভার রেখেছেন তার সাইটে। গ্রোসারি থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স এমনকি মেডিসিন ক্রয়ের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আয়েশার ‘কাইট হাট’। প্রায় দু’বছর ধরে নিজের ব্যবসা সাজাতে তিল তিল করে ঘাম ঝরাচ্ছেন পরিশ্রমী এই নারী উদ্যোক্তা। দুই কন্যার জননী আয়েশা সংসার সামলানোর পাশাপাশি সমান তালে সামলাচ্ছেন তার ‘কাইট হাট’। ‘ফিউশন বাই চৈতী’ নামক একটি ফেসবুক পেজ চালান চৈতী। নিজের ডিজাইন করা থ্রি-পিস ও শাড়ি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে তার এই প্রয়াস। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও নিজ পেশায় নিয়োজিত না হয়ে অনলাইন ব্যবসায়ের প্রতি ঝুঁকেছেন চৈতী। মাত্র ছয়মাস আগে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করা তার এই অনলাইন ব্যবসার পুঁজি এখন দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখ টাকায়। ভবিষ্যতে নিজের [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান চৈতী। আয়েশা ও চৈতীর মতো অনেক নারী ইদানীং অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত বর্তমান যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র আজ প্রযুক্তিনির্ভর। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ঘরের নারীরা। নারীরাও আজ প্রযুক্তিবান্ধব। অনলাইন ফ্যাশন হাউস, জুয়েলারি হাউসসহ নিত্যপণ্যের সম্ভার এখন অনলাইনে। ঘরে বসে কল করে কিংবা মেসেজ পাঠিয়ে পছন্দের পণ্যটি ক্রেতাদের হাতের নাগালে পৌঁছে দিচ্ছে অনলাইন উদ্যোক্তারা। অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কর্ণধারই নারী। এ ধরনের ব্যবসায় জড়িত থেকে নারীরা ঘরে বসেই যেমন উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছেন তেমনি ক্রেতারাও ঘরে বসে তাদের পণ্যটি বুঝে পাচ্ছেন। ই-কমার্স নারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়াচ্ছে যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দিক বলে মনে করেন ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সভাপতি রাজিব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ই-কমার্স। এই সেক্টরে নারী উদ্যেক্তাদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তা আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। আরেকটি বিষয় হলো, অনলাইনভিত্তিক ক্রেতা হিসেবেও সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে আছেন নারীরা। ঢাকা শহরে মাত্র কয়েকটি মার্কেটে সীমাবদ্ধ। এই পরিসরে ক্রেতারা তাদের পছন্দের জিনিস অনেক সময় খুঁজে নাও পেতে পারেন। কিন্তু অনলাইন মার্কেটিং ও ফেসবুকের বিভিন্ন পেজের মাধ্যমে ক্রেতারা তাদের পছন্দের পণ্যটি হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের তথ্য অনুযায়ী ৮ হাজার ফেসবুক পেজ, এরমধ্যে প্রায় ৫ হাজার পেজ চালান নারী উদ্যেক্তারা। প্রতিদিন গড়ে বিশ হাজার টাকা ও মাসে ৬ লাখ টাকার পণ্য ডেলিভারি হচ্ছে অনলাইন বাজারগুলোতে। ইক্যাবের তথ্যমতে, গত বছর এক হাজার কোটি টাকা ই-কমার্স সেক্টরে লেনদেন হয়েছে।’ কথা হয়েছিল আরও এক অনলাইন উদ্যোক্তা জাহিন আফরোজের সঙ্গে। দেশী এবং হাতে তৈরি পণ্য দিয়ে তিনি শুরু করেন ‘সাতরঙ’। তার পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক ও জুয়েলারি। নারীদের জন্য রয়েছে যেমন পণ্য-সামগ্রী তেমনি পুরুষদের জন্যও রয়েছে। নিজের পছন্দ ও ডিজাইনে তার পণ্য তৈরি হয়। যেকোন বয়সের নারী-পুরুষই তার গ্রাহক হতে পারেন। ক্যাশ অন ডেলিভারি এবং বিকাশে তিনি পেমেন্ট নিয়ে থাকেন। ফেসবুক পেজের মাধ্যমেই তিনি তার ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দামের ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন। তার উৎপাদন খরচ ও বাজার যাচাই করে তিনি পণ্যের দাম ঠিক করে থাকেন এবং দাম ও চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে সর্বোচ্চ মান দেয়ার চেষ্টা করেন, আমাকে এমনটাই বলেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘নারীদের জন্য এবং ই কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য কম মুনাফায় ও সহজ শর্তে লোনের ব্যবস্থা থাকলে তিনি ব্যবসাটা আরও বড় করে শুরু করতেন’। তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ই কমার্স বাজারের দিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানান। যেসব ক্রেতা ভিন্ন ধরনের এক্সক্লুসিভ ব্লক ও প্রিন্টের থ্রী-পিস খুঁজছেন, তারা চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন ‘নুসরাতস অ্যাটায়ার্স’ পেজে। এই পেজের কর্ণধার নুসরাত জানান, ‘এ মাসের মাঝামাঝিতে পহেলা ফাল্গুন ও ভালবাসা দিবস হওয়ায় বিভিন্ন পোশাকের ডিজাইন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ উদ্যোক্তা। জানালেন, ‘প্রথম দিকে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেই অনলাইনের এই ব্যবসা চালু ছিল। কিন্তু দিন দিন তার গ্রাহক বা ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে ‘নুসরাতস অ্যাটায়ার্স’ পেজের লাইকারের সংখ্যাও।’ বর্তমানে নারীর ঝোঁক বাড়ছে অনলাইন ব্যবসায়ে। তথ্য প্রযুক্তির এই সম্ভাবনার যুগে নারীর পথচলা আরও সুগম হয়েছে বলে মন্তব্য করলেন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) জনসংযোগ কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা মাহমুদ তুহিন। তিনি বললেন, ‘ই-কমার্স বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সুফল বয়ে এনেছে। অনলাইন শপিং সাইটসহ ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন। বর্তমানে বেসিসের তালিকাভুক্ত প্রায় দুই হাজার ফেসবুক পেজ আছে যার মধ্যে ধারণা করা যায় প্রায় তিন শ’ পেজ নারী উদ্যোক্তাদের। এছাড়া একহাজার অনলাইন শপিং সাইট আছে এগুলোর মধ্যে প্রায় দুশটি ওয়েবসাইট নিয়মিত চলছে। এখানেও অনেক নারী উদ্যোক্তা আছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। আমাদের দেশের অনেক নারী আছেন যারা ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করতে পারছেন না কিন্তু তারা স্বাবলম্বী হতে চান। সেদিক থেকে ই-কমার্সের মাধ্যমে নারীরা ঘরে বসে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ই-কমার্সের সুবিধা হলো- অল্প পুঁজিতে এমনকি বিনা পুঁজিতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াই ব্যবসা করা যায়। ই-কমার্স মেয়েদের জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার অন্যতম মাধ্যম। শুধু একটু ব্যবসায়িক জ্ঞান থাকলেই উন্নতি করা সম্ভব এ মাধ্যমে। ভবিষতে ই-কমার্স সেক্টরে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়।’ উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি অনলাইনে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ই-কমার্স সংশ্লিষ্টরা। বেচাকেনার জন্য নির্দিষ্ট সাইটগুলোর পাশাপাশি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও জমে উঠেছে এই কেনাবেচা। বিশেষ করে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পেজ। আর তা থেকেই ক্রেতারা খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দের পণ্য। উদ্যোক্তাদের মতে, নতুনদের পাশাপাশি বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেসবুক। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। ব্যবসা করতে লাগে না কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা পরিচালনা করা যায় ঘরে বসেই। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে এ মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কথা হলো কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গেও। আফিফা তাবাসসুম একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। অফিস করে সংসার সামলানো সেই সঙ্গে বাচ্চাদের দেখাশুনার পর বাড়তি সময় গুছিয়ে নিতে পারেন না শপিং করার জন্য। এজন্য তিনি পুরোপুরি নির্ভরশীল অনলাইন শপিং সাইটগুলোর উপর। ফেসবুকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বেছে নেন তার পছন্দের পণ্যটি। তিনি জানালেন, ‘যেহেতু সময় করে উঠতে পারি না। এছাড়া যানজট আর ভিড় ঠেলে মার্কেটে যেতেও ইচ্ছা করে না। তাই অনলাইন শপিং আমার শেষ ভরসা। ওয়েবসাইটগুলোতে ফোন নম্বর দেয়া থাকে সেখানে তাদের সাথে কথা বলে পণ্য সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায় এবং অর্ডার দেয়ার পর কোন ঝামেলা ছাড়াই বাসায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে পছন্দের পণ্যটি। আমি গত এক বছর ধরে অনলাইনের মাধমে পণ্য কিনছি। সঠিক সময়ে ঘরে বসে পণ্য হাতে পেয়ে লেনদেন করছি।’ আফিফার মতো অনেক ব্যস্ত নারী ক্রেতার ভরসা এখন অনলাইন শপিং সাইট। গত কয়েক বছর ধরেই অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি আস্থা বেড়েছে ক্রেতাদের। সঙ্গে বেড়েছে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা। তবে ইদানীং অনলাইন কেনাকাটায় অনেকে আবার প্রতারণার ফাঁদেও পড়ছেন। ছবির পণ্যটির সঙ্গে বাস্তবের পণ্যটির মিল খুঁজে পাননি অনেক ক্রেতারা। তাদের অভিযোগ, হোম ডেলিভারির মাধ্যমে তারা যখন সেই পণ্যটি হাতে পাচ্ছেন তখন তাদের পছন্দের রঙের সঙ্গে ডেলিভারির পণ্যটির কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাননি। এছাড়া পণ্যের দাম নিয়েও রয়েছে ক্রেতার মনে সংশয়। অনেকের অভিযোগ অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো লোক ঠকিয়ে রোজগার করে। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা না করে বরং তাদের আস্থা অর্জনে জন্য উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিলেন ই-ক্যাবের সভাপতি। তিনি বললেন, ‘যখন ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের ছবিটি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছে। তখন তাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে নির্দিষ্ট পণ্যের রং পনেরো-বিশ যেন না হয়। উনিশ-বিশ হলে সমস্যা নেই। এছাড়া, পণ্যের মূল্য বেশি হাঁকিয়ে ব্যবসা করা যাবে না। ব্যবসায়ীরা লাভ করকে এটাই স্বাভাবিক তবে লোক ঠকিয়ে যেন উদ্যোক্তারা লাভ না করে সেদিকে তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।’
×