ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী গ্রেফতার

গুলশান হামলার প্রথম জীবিত পরিকল্পনাকারী সরকারের হাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

গুলশান হামলার প্রথম জীবিত পরিকল্পনাকারী সরকারের হাতে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে জীবিত এক পরিকল্পনাকারী সরকারের হাতে এখন। রাজীব গান্ধী ছিল ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া শীর্ষ জঙ্গী নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও তার জামাই আব্দুল আউয়ালের পাঁচক। সে গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলা ছাড়াও অন্তত ২২ হত্যার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে সে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। গুলশান হামলায় যারা অংশ নিয়েছিল তাদের দু’জনকে নিয়োগ দিয়েছিল সে। হামলার সময় বসুন্ধরার বাসায় বসে পুরো ঘটনা মনিটরি করে। এরপর সেখান থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় আত্মগোপন করে। গ্রেফতারের পর রাজীব গান্ধীর কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে গুলশান হামলাসহ বহু নৃশংস হত্যাকা-ের চাঞ্চল্যকর অজানা সব তথ্য। তাকে আট দিনের রিমান্ডে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। শনিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে টাঙ্গাইল জেলার এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে (৩২) গ্রেফতার করা হয়। জাহাঙ্গীর আলম রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ ওরফে শান্ত ওরফে টাইগার ওরফে আদিল ওরফে জাহিদ নামেও পরিচিত। তার পিতার নাম মরহুম মাওলানা ওসমান গণি। মা রাহেলা বেগম। বাড়ি গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানাধীন পশ্চিম রাঘবপুরের ভূতমারা গ্রামে। শুভ নামে তার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ২০১৫ সালে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে হিজরত করে রাজীব। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেছে সে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব গান্ধী গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গী নেতা ও গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাজীব। এ দু’জনের সঙ্গে গুলশান হামলার পরিকল্পনায় রাজীব সরাসরি জড়িত। সে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা। উত্তরবঙ্গের সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। তারই সার্বিক পরিকল্পনায় জাপানী নাগরিক হোসি কুনিও হত্যা, টাঙ্গাইলের গোপালপুরে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, পাবনার পুরোহিত নিত্যরঞ্জন পা-ে, রংপুরের মাজারের খাদেম রহমত আলী, কুষ্টিয়ার চিকিৎসক সানাউর, পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর, দিনাজপুরের হোমিও চিকিৎসক ধীরেন্দ্র নাথ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা, শিয়া মসজিদে হামলা ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীসহ অন্তত ২২টি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ে রাজীব সরাসরি অংশ নিয়েছিল। বাকিগুলোতে অংশ না নিলেও সার্বিক পরিকল্পনা ও হত্যাকা- বাস্তবায়নে নানাভাবে হত্যাকারীদের সহযোগিতা করে। রাজীব গান্ধী গুলশান হামলায় অংশ নেয়া এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হওয়া মোঃ খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাঁধন ও মোঃ শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশকে নব্য জেমএবিতে যোগদান করিয়েছিল। পরে তাদের গুলশান হামলার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিল। সার্বিক পর্যালোচনা করে এ দু’জনকে গুলশান হামলার জন্য বাছাই করেছিল রাজীব। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে হামলাকারীদের একজন শফিউল ইসলাম ওরফে ডনকেও সেই নব্য জেএমবিতে যোগদান করিয়েছিল। তাকেও প্রশিক্ষিত করে হামলায় অংশ গ্রহণ করিয়েছিল। গুলশান হামলার এক সপ্তাহ আগ থেকে রাজীব স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকের ই-৩ নম্বর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি গিয়াস উদ্দিন আহমেদের বাড়িতে অবস্থান করছিল। বাড়িটি গুলশান হামলার অপারেশনাল হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাড়িটিতে হামলাকারীদের থাকার জন্য ভাড়া করে দেন এ মামলায় কারাবন্দী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম। এ বাড়িটি থেকে বেরিয়ে গিয়েই হামলাকারীরা হলি আর্টিজানে হামলা চালায়। রাজীব সেই বাড়িতে অবস্থান করে গুলশান হামলার সার্বিক বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে ও মনিটরিং করে। হামলা চালানোর পর রাজীব ওই বাড়ি থেকে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় চলে যায়। গুলশান ও শোলাকিয়াসহ অনেক হামলার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে গত বছর ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নয় জঙ্গী নিহত হওয়ার পালানোর সময় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যানের ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে। জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে রাজীব গান্ধীর নাম। মনিরুল ইসলাম জানান, নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়ার আগে রাজীব গান্ধী জেএমবির শূরা সদস্য ডাঃ নজরুল ইসলামের সহযোগী ছিল। সে মূলত ২০০৪ সালে জেএমবিতে যোগ দেয়। ওই সময় সে ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া শীর্ষ জঙ্গী নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের মেয়ের জামাই আব্দুল আউয়ালের পাঁচক ছিল। আব্দুল আউয়াল ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) যুগপৎ বোমা হামলার বগুড়ার দায়িত্বে ছিলেন। জাহাঙ্গীর তার পাঁচক হিসেবে কাজ করতেন। পাশাপাশি বাইসাইকেলে জাহাঙ্গীর জঙ্গীদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করার কাজে জড়িত ছিল। জেএমবির যুগপৎ হামলায় আবদুল আউয়ালের নাম প্রকাশ পেলেও এতদিন গোপনেই ছিল রাজীব গান্ধীর জড়িত থাকার বিষয়টি। দীর্ঘদিন জঙ্গীদের সঙ্গে কাজ করায় রাজীবের সাংগঠনিক তৎপরতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, ভারতে অবস্থানরত মানিক ও মামুনুর রশিদ রিপনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। ২০১১ সালে জেএমবি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ওই সময় রিপন-মানিকের সঙ্গে রাজীব কাজ করত। ২০১৪ সালের পর নব্য জেএমবির গঠন হলে রাজীবের যোগাযোগ হয় তামিম চৌধুরীর সঙ্গে। সে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। আব্দুল আউয়ালসহ শীর্ষ জঙ্গীদের সংস্পর্শে এসে রাজীব গান্ধীও ভয়ঙ্কর জঙ্গী রূপে আবির্ভূত হয়। গুলশান হামলায় জড়িতদের মধ্যে একমাত্র রাজীব গান্ধীকেই জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত আরও তিনজন পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। এরমধ্যে বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট অন্যতম। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন, স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের উপকমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান ও মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, শনিবার রাজীব গান্ধীকে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। ঢাকার মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসান তাকে আট দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন। আসামির পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন না। গত বছরের ১ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে জঙ্গীরা গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালায়। এ সময় বাধা দিতে গিয়ে নিহত হন বনানী থানার ওসি ও ডিবির সহকারী এক কমিশনার। এরপর জঙ্গীরা রেস্তরাঁর ভেতরে ১৭ বিদেশী ও তিন বাংলাদেশীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরদিন সকালে জিম্মিদের উদ্ধার করে অভিযান চালায় সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। অভিযানে গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার ছাত্র মীর সামেহ মোবাশ্বের, মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলাম এবং বগুড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল নিহত হয়। অভিযানে রেস্তরাঁর পাঁচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। তিনিও সন্দেহভাজন জঙ্গী ছিলেন বলে তদন্তকারীদের ধারণা। পরবর্তীতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেস্তরাঁর আরেক কর্মী জাকির হোসেনের মৃত্যু হয়। হলি আর্টিজানে হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময় পুলিশের অভিযানে নিহত হয়। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় গুলশান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ডের একজন নুরুল ইসলাম মারজান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশান হামলায় জড়িত পলাতকদের মধ্যে অন্যতম বাশারুজ্জামান চকলেট ও সাগর। সাগর গুলশান হামলায় ব্যবহৃত ভারত সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্রের চালানটি গ্রহণ করে। পরে তা ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছে দেয়। আর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বাশারুজ্জামান চকলেট মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফায় হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করে। টাকাগুলো গুলশান হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়। বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন, মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি ও তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা এবং তার ছেলে আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতারের পরেও এমন তথ্য দিয়েছে।
×