ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াস বাবর

যিনি বরাবরই থেকে যান স্রোতের বিপরীতে

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২১ অক্টোবর ২০১৬

যিনি বরাবরই থেকে যান স্রোতের  বিপরীতে

বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক আর কথাসাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের নোবেলবিষয়ক দারুণ এক গল্প আছে। সেবার সাহিত্যে নোবেল পান আমেরিকান ঔপন্যাসিক সল বেলো, সন্দীপনের তখন তুমুল খ্যাতি- কাউকে পাত্তাই দেন না। সন্দীপনের- নিজেকেই অন্ধভাবে সমর্থন করা সময়ে সৈয়দ হক যান কলকাতায়। বাংলাদেশের লেখক বলেই হয়তো উন্নাসিকতা আর জব্দ করার মানসে অবজ্ঞামেশানো গলায় সন্দীপন বললেন, ‘এই যে হক সাহেব, এ বছর সাহিত্যে যিনি নোবেল পেলেন, সল বেলো, তাঁর নাম শুনেছেন?’ তিনিও কি আর ছেড়ে কথা বলবেন, মানুষটা যখন সৈয়দ হক! তিনি বললেন- ‘শুনুন সন্দীপন বাবু, আপনি যখন হাফপ্যান্ট পরেন, তখন সল বেলোর একটি উপন্যাস আমি বাংলায় অনুবাদ করেছি।’ আসলে যিনিই সাহিত্যে নোবেল পান না কেন; যতই অনালোচিত হোক তবুও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর তার খ্যাতি বেড়ে যায় হু হু করে। তিনি সারা পৃথিবীতে তো বটেই, তাবত সাহিত্যকর্মীদের আলোচনায়ও থাকেন তুমুলভাবে। আমরাও বাদ যাবো কেন? যেখানে সৈয়দ হক আর সন্দীপন পরস্পর মেতে উঠেন তর্কে; এই সময়ে, এই সামাজিক মিডিয়ানির্ভর আর দ্রুত তথ্যপ্রাপ্তির সময়ে আমরাও জেনে যাই বব ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তির খবর। অতঃপর নানারকম খবর আর আলোচনায় যাচাই করি নিজেদেরই তুলাদ-েÑ কেন লোকটাকে নোবেল দেয়া হলো? চালাক-চতুর মানুষেরা তাতে খোঁজেন বিশ^শক্তিধর দেশসমূহের পক্ষপাতিত্বের গন্ধও! বব ডিলানÑ যিনি কিনা সঙ্গীতেরই মানুষ পুরোপুরি; নোবেল কব্জা করেন সাহিত্যে, সঙ্গীতের উল্লেখযোগ্য পুরস্কারসমূহ বগলদাবা করার পরেই। তবে আমরা এ-ও তো দেখিÑ বেশ ক’বছর ধরেই নোবেল কমিটি চমক দেয়ায় যে পটু তার নমুনাও কিন্তু রেখে যাচ্ছেন সমানতালে। এক আলোচক হয়তো এটা অনুমান করেই বলেনÑ ‘... তবে নোবেল কমিটির চমকে দেওয়ার ক্ষমতাকে কেউ অস্বীকার করছেন না। ফলে বব ডিলানের ওপর অনেকেই বাজি ধরছেন।’ এখানেই আমরা আলোচনার সূত্র পেতে পারিÑ দুনিয়ার বাঘা বাঘা সাহিত্যিকরা থাকতে বব ডিলানেই কেন বাজি ধরবেন সচেতন মানুষ। এর দুটো কারণ হতে পারেÑ তিনি নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেছেন ইতোমধ্যে অথবা অনেক দিন ধরেই নোবেল সর্টলিস্টে তার নাম থাকা। তবে যে যুক্তিতে আমরা বব ডিলানকে খারিজ করতে চাই সাহিত্য থেকে ঠিক একই যুক্তিতে প্রশ্ন তোলা যায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল নিয়েও! কেননা, বাংলার শিক্ষার্থীসমাজ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে জেনে যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছেন ‘গীতাঞ্জলী’ নামক অসাধারণ কিতাব সৃষ্টির কল্যাণেই। এবং শিক্ষার্থীসমাজ যখন বড় হয়ে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কিতাবটি পড়ে কিংবা জানে তারা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে এ-তো গানই; এর চেয়ে উত্তম সঙ্গীত আর কি হতে পারে? তাহলে বব ডিলান কি সঙ্গীতকার হয়ে সাহিত্যে নোবেল জয় করে অপরাধ করেছেন? না, তবে প্রতিবারের মতো খুঁত ধরার মানুষ না থাকলে তো আর জমে না আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। এখানে নিবিড়ভাবে এ-বাণীও সম্ভবত নোবেল কমিটি পৌঁছান যে, শিল্প-সাহিত্য যাই হোক না কেন তাকে প্রথমেই হতে হবে জনমুখী এবং কমিউনিকেটগুন সম্পন্ন। বব ডিলানের গানে তা অবশ্যই আছে; সেদিকেই তাহলে নজর দেয়া যাক। সৃজনশীলতায় হৃদয়ছোঁয়া সহজিয়া গীতল-ভাবটিই বরং নোবেল কমিটি এবারের সাহিত্য-পুরস্কারের মাধ্যমে সম্মাননা জানায়। অবশ্য আমরা নোবেল কমিটির কাছ থেকে ব্যাখ্যাকারেই শুনিÑ ‘মহান আমেরিকান সঙ্গীতের ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক প্রকাশভঙ্গি উদ্ভাবনের জন্য-ই’ বব ডিলান এ-পুরস্কার অর্জন করেন। মূলত যা কিছু সুন্দর কল্যাণকর তা ব্যক্তি তো বটেই জাতীয়তা ছেড়ে হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক। বব ডিলানের অপূর্ব গানের কথার সর্বত্রই আমরা মানুষের কথা শুনি, মানবতার জয়গানই যেন তার আরাধ্য, শান্তির বার্তা বয়ে বেড়ানোই যেন তার অন্বিষ্ট। প্রিয় পাঠক, দেখুন ডিলানের গানের কথাÑ ‘আমার অস্ত্র মাগো, দাও নিচে রেখে/ তাদের মারতে আমি পারব না আর/ নেমে আসে কালো মেঘ চারপাশে ঢেকে/ যেন আমি স্বর্গের দরজায় ঠক ঠক করি বারবার।’ কত সহজ, কত সরলভাবেই যায় মানুষের পক্ষে! বিশ^ব্যাপী দখলদারিত্বের লড়াইয়ে, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে, রক্ত-লেলিহান খেলার বিপরীতে এর চেয়ে সুন্দর বাণী আর কী হতে পারে! যে অনায়াসেই বলতে পারেÑ আমার ব্যাজ খুলে নাও; তাকে তো পুষ্পিত অভিনন্দন জানাতেই হয়! নোবেল কমিটি বব ডিলানকে সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে অপাত্রে যে দেননি তারই সাক্ষ্য যেন আমরা বারবার পাই বব ডিলানের জীবন-সঙ্গীতে। বব ডিলান আমেরিকার নাগরিকÑ যারা কিনা বিশে^র মোড়লীপনা আর যুদ্ধের দামামা বয়ে না বেড়ালে শান্তি পায় না। স্বার্থের প্রশ্নে পক্ষপাতিত্ব নেয় ঘাতকের। তবুও ডিলান তো শিল্পীÑ মানবিকতার চাষই যার উদ্দেশ্য। ফলে ডিলান গেয়ে উঠেনÑ ‘বিদায় অপরিচিতা/ এই বিদায়ের সুর/ চুপিচুপি, ডাকে দূর বহুদূর/ দিগন্তে রয়েছে আকাশ একাই/ বিদায় অপরিচিতা/ আকাশ নিঃসঙ্গ, তার কাছে যাই।’ প্রকারান্তরে শিল্পী কি নিজ দেশের নির্লজ্জ নীতি কিংবা পৃথিবীর অনাচার থেকেই পালিয়ে যেতে চান? হায়Ñ মানুষ এককভাবে বড়ই নিঃসঙ্গ প্রাণী, তাকে বেঁচে থাকতে হয় শোক-তাপ, আনন্দ-বেদনার মধ্যেই। তাকে বেঁচে থাকতে হয় ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে, অনাগত দিনের বয়েসী হয়ে। হয়তো এ-কারণেই বব ডিলান তার সাক্ষাৎকারে পুরনো গান বদলে গাওয়ার প্রসঙ্গ ধরেই বলেনÑ ‘সবসময়েই আমাকে প্রতিটি গানের, এমনকি পুরনো গানেরও নতুন অর্থ খুঁজে নিতে বলে। নতুনতর অর্থের খোঁজ করাটা সব সময়েই জরুরী। গানের আদত শরীর অবশ্য একই থাকে আমার, শুধু পালটে যায় তার পোশাক।’ কিন্তু সাহিত্যে আমরা অনেক কিছুকেই পুরনো বলে উড়িয়ে দেই, কোন কোন সাহিত্যিককে ফেলে দেই বাতিলের খাতায়। পুরনোকে নতুনভাবে আবিষ্কারের কৌশল কি আমরা আদতেই জানি? নাকি ইতিহাস ভোলার মতো প্রাতঃস্মরণীয়দের ভুলে যাওয়াটাই একটা ফ্যাশন? বব ডিলান রক তো গেয়েছেনই বাদ দেননি হারিয়ে যাওয়া ফোকগানও; তার উদ্দিষ্ট সবসময়েই শেকড়সন্ধানী ছিল। ‘কতোটা পথ পেরুলে তবে পথিক বলা যায়?/ কতোটা পথ পেরুলে পাখি জিরোবে তার ডানা?/ কতোটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়?/ প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরওতো জানা...’ বব ডিলান এভাবেই আমাদের বিবেকের সামনে তুলে ধরেন আত্মপ্রতিকৃতি। নিজেকেই যেন মুখোমুখি করে ভেতরকার মানুষটির সঙ্গে। একইসঙ্গে প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে বব ডিলান হাজির হন এভাবেইÑ ‘আমি প্রত্যাশা করি তোমার মৃত্যু হোক/ তোমার মৃত্যু খুব শীঘ্রই হোক/ এক বিবর্ণ বিকেলে/ আমি তোমার শবাধারের পিছে যাব...’ কিছু অমঙ্গলকামীÑ জনসাধারণের অকল্যাণ বয়ে আনে জগতের বিচিত্র মাজারে। বব ডিলান তাদের মৃত্যুই কামনা করে; কালিমা দূরই হয়ে উঠে শিল্পীর চূড়ান্ত গন্তব্য। তিনি মানুষের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে ধারণ করেন সময়ের কণ্ঠস্বর যা রোধ করা যায় না, ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে, চারদিকে। বাঙালীরা অন্যের আনন্দে উল্লসিত আর অন্যের বেদনায় অশ্রুসিক্ত হতে ভালোবাসে। বব ডিলান কেন শুধু মো ইয়ান নোবেল পেলেন তাতেও তৃপ্তির ঢেকুর তোলে, হারুকি মুরাকামি কেনইবা বারবার বাদ পড়েন তা নিয়ে ব্যথিতও হয় প্রবলভাবে। কিন্তু বব ডিলানের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদাÑ অসম্ভবরকম জড়ানো আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশেরই সমর্থনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের গর্বিত শরিক ছিলেন ডিলানও! এ কারণেও বাংলাদেশীরা বব ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তিকে ঘরের মানুষের, প্রিয় স্বজনের, অকৃত্রিম বন্ধুর বিশ^স্বীকৃতি বলেই মনে করে। কোটি বাংলাদেশী প্রাণের প্রণতি জানায় বব ডিলানেরই সুবিশাল মানবিক সত্তাটিকেই। বব ডিলানকে তাই অন্যান্য অগ্রজ নোবেলজয়ীর মতোই নয় শুধু, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাটা বরং বেশিই দেখাতে চায় এদেশেরই সৃজনশীল মানুষরা। এবং রবীন্দ্রনাথের মহত্তম কিতাবটির মতো বব ডিলানেরই সঙ্গীত-দুনিয়ায় পর্যটন শেষে আবিষ্কার করবো দুনিয়ার বিবেক। ডিলান বরং এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কেন অন্যান্য সেরা সেরা কবিদেরও পেছনে ফেলেন তার জাদুকরী গায়কির মাধ্যমেÑ যা সরাসরি এবং বিপুল অক্ষরজ্ঞানহীন শ্রোতাদেরও আনন্দ দিতে পারে। নোবেল কমিটি জনসংযোগের ক্ষমতাকে মাথায় নিলেও আমরা ফেলে দিতে পারি না ডিলামের চিত্রকর্মÑ যা পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রদর্শিত হয়েছে; আর আছে তার স্মৃতিকথাÑ যা অনায়াসেই দাবি করতে পারে সাহিত্যিক মর্যাদা। ‘কীভাবে এ ব্যাজ আমি করি ব্যবহার?’ বলেই আকুতি জানান বব ডিলান। ক্ষমা প্রার্থনা করেন মানুষের কাছে, মায়ের কাছে। কিন্তু বব ডিলানের দেশই তো পৃথিবীতে যত অশান্তি ঘটানোর নেপত্তে কাজ করে। বব ডিলানÑ তিনিও মানুষ, তারও সীমাবদ্ধতা আছে। তবুও গান দিয়েই তিনি অনায়াসে পৌঁছে যান পৃথিবীর মানবিক মানুষের কাছে। আমরা নোবেল কমিটির সমালোচনা না করে বরং ‘স্বর্গের দরজায় ঠক ঠক ঠক করা’ বব ডিলানের জন্যই প্রশস্তিগাথা রচনা করবো। কারণ তিনি যুদ্ধপ্রিয় দেশের নাগরিক হয়েও গেয়ে যান যুদ্ধের বিরুদ্ধে, যদিওবা আমেরিকা শোনে না একজন শিল্পীর কথা; এ দুঃখ বব ডিলানের শিল্পীজীবনের নয় শুধু, পৃথিবীর অবিসংবাদিত সব সৃজনশীল মানুষেরই!
×