ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩০ সংগঠন অবৈধ নম্বর প্লেট বাণিজ্যে জড়িত

দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ অবৈধ রিক্সা

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ অবৈধ রিক্সা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্সার তুলনায় ১০ গুণ রিক্সা রাজধানীতে চলাচল করছে। অন্তত ৩০টি সংগঠন ও সমিতির নামে এসব অবৈধ রিক্সা রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব সমিতি বা সংগঠনের পক্ষ থেকে রিক্সাগুলোতে দেয়া হয় কথিত নম্বর প্লেট। একেকটি রিক্সায় এ ধরনের দুই থেকে পাঁচটি করে নেমপ্লেট দেখা যায়। এসব নম্বর প্লেটকে কোন কোন রিক্সাচালক লাইসেন্স বলেও মনে করেন। কখনও কখনও বৈধ রিক্সাতেও এই অবৈধ নম্বর প্লেট ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি করে নম্বর প্লেট ব্যবহারে বাধ্য করার অভিযোগও রয়েছে। রাজধানীর রিক্সা পরিচালনাকারী এসব সংগঠন, রিক্সাচালক ও সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের পর রিক্সার লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত ৮৭ হাজার ৮১১টি লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর ২৮ হাজার ৮৩০টি রিক্সা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় যায়। বাকিগুলো দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে রয়েছে। এর বাইরে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে আরও ৫০ হাজারের মতো বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্সা রয়েছে, যেগুলো রাজধানীতে চলতেও দেখা যায়। অবশ্য গত ২৮ জুন এসব ইউনিয়নগুলো সিটি কর্পোরেশনের আওতায় চলে আসায় এ রিক্সাগুলোর লাইসেন্সও কার্যত বৈধ থাকার কথা নয়। জানা গেছে, রাজধানীতে বর্তমানে রিক্সার সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এর সংখ্যা ১১ লাখের কম হবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা (ইউআরপি) বিভাগের ২০১৪ সালের এক গবেষণায় রাজধানীতে অনিবন্ধিত রিক্সার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়। এর আগে ২০১২ সালে বেসরকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের এক গবেষণায় বলা হয়, রাজধানীতে অনিবন্ধিত রিক্সার সংখ্যা আট লাখের বেশি। এসব রিক্সা সরকারী কোন সংস্থা বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে নিবন্ধন না পেয়ে বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে ‘অনুমোদন’ নিয়ে থাকে। নির্ধারিত ফিসে এই সমিতি থেকে বিক্রি করা হয় সিরিয়াল নম্বর সংবলিত নিবন্ধন কার্ড। আর এসব কার্ড পেছনে লাগিয়েই চলছে অনিবন্ধিত রিক্সাগুলো। জানা গেছে, ছয় মাস মেয়াদী এ নিবন্ধন কার্ডের জন্য দুই শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কথিত সংগঠনের নামে রিক্সার নম্বর প্লেট দেয়া শুরু হয়। ‘রিক্সা চোর প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি সংগঠন সর্বপ্রথম এ কাজটি শুরু করে বলে জানা যায়। পরে এ সংগঠনের বিরুদ্ধেই রিক্সা চুরির অভিযোগ ওঠে। এতে নাম পাল্টে শুরু হয় বিভিন্ন সংগঠনের নামে রিক্সা নম্বর প্লেট দেয়ার কথিত ব্যবসা। ছোটবড় ৩০টির মতো সংগঠন এসব নম্বর প্লেট বিক্রি করলেও বাংলাদেশ রিক্সা ও ভ্যান ফেডারেশন, ঢাকা বিভাগ রিক্সা ও ভ্যান মালিক সমিতি, রিক্সা ও ভ্যান মালিক শ্রমিক লীগ, মহানগর রিক্সা মালিক লীগ, মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় পরিষদ-ঢাকা বিভাগের নামেই বেশির ভাগ নম্বর প্লেট দেখা যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ রিক্সা ও ভ্যান ফেডারেশনের নামেই রয়েছে অন্তত দেড় লাখ নম্বর প্লেট। রাস্তায় এই সংগঠনের নামে ১২৬৮০২ ক্রমিকের রিক্সা নম্বর প্লেট চোখে পড়েছে। রিক্সার মালিকেরা এই নম্বর প্লেটকে রিক্সার বৈধ লাইসেন্স মনে না করলেও অনেক রিক্সাচালকই এটাকে লাইসেন্স হিসেবেই জানেন। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকার এক রিক্সামালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, সিটি কর্পোরেশন লাইসেন্স না দেয়ার কারণে তারা এসব সংগঠনের সদস্য হয়ে তাদের থেকে নম্বর প্লেট নিয়ে রিক্সা চালু করেন। এটা রিক্সার লাইসেন্স নয় তিনি সেটা জানেন। তবে সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন থাকায় এর নম্বর প্লেট ব্যবহার করে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। শরীয়তপুর থেকে রাজধানীতে রিক্সা চালাতে আসা আবুল কালাম জানান, রিক্সা ভাড়া নেয়ার সময় কোন লাইসেন্স তাদের কাছে মালিকরা দেয় না। পেছনে যে নম্বরগুলো রয়েছে, এগুলোই তো লাইসেন্স হবে বলে হয়। অবশ্য সংগঠনের পক্ষ থেকে যেসব নম্বর প্লেট দেয়া হয়, তা কোন বৈধ লাইসেন্স নয় বলে জানান বাংলাদেশ রিক্সা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশনের নেতা রুস্তম জামান। তিনি বলেন, এগুলো লাইসেন্স নম্বর নয়, সমিতির সদস্য নম্বর। এতে করে তাদের সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে কতগুলো রিক্সা রয়েছে, তার তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া এই নম্বর প্লেট থাকায় রিক্সা চুরি হলে সমিতির মধ্যস্থতায় রিক্সা ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকে। সংগঠনের নেতারা জানান, সিটি কর্পোরেশন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে রিক্সা মালিক সংগঠনের বৈঠকে রাজধানীতে নতুন ৩৫ হাজার রিক্সা ও আট হাজার ভ্যানসহ মোট ৪৩ হাজার রিক্সা-ভ্যানের নতুন নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেটা আর দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে মালিক ফেডারেশন এক হয়ে ঢাকার নিম্ন আদালতে একটি মামলা করেছে, যেটি এখনও চলমান। জাতীয় রিক্সা ভ্যান মালিক শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী বলেন, সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল, সেই অনুযায়ী তারা সিটি কর্পোরেশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন পরবর্তীতে সেগুলোর নিবন্ধন দেয়নি। পরে একান্ত বাধ্য হয়ে তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে নম্বর প্লেট দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অন্যান্য সংগঠন কতজনকে সদস্য নম্বর দিয়েছেন, তা তার জানা নেই। তবে তাদের সংখ্যা ৩৫ হাজারের মতো। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বলেন, সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স ছাড়া সিটি এলাকায় যেসব রিক্সা চলাচল করে, তার সবই অবৈধ। সিটি কর্পোরেশন ছাড়া অন্য কারও লাইসেন্স দেয়ার সুযোগ নেই। বিভিন্ন সংগঠনের নামে যেসব রিক্সা চলে, তার কোনটিই বৈধ নয়। তিনি বলেন, এ অবৈধ রিক্সাগুলো আমরা পুলিশের সহযোগিতায় উচ্ছেদ করে ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। নিয়মিতভাবেই এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চলে। নতুন লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আগে প্রায় ৮০ হাজার রিক্সার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। ওইগুলোই বৈধভাবে চলছে। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যেগুলো লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা।
×