ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ কাদরীকে তো কেউ দেশে ডাকেননি...

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৩০ আগস্ট ২০১৬

শহীদ কাদরীকে তো কেউ দেশে ডাকেননি...

দাউদ হায়দার, জার্মানি থেকে ॥ তিনি আমার বয়সে বড়। মারা গেছেন। আমি গত বছরই উনার ওখানে দীর্ঘ সময় কাটালাম, নিউইয়র্কে। খুবই পরিচিতজন। যেহেতু উনার চেয়ে আমি বয়সে ১০ বছরের ছোট। আমি উনার বন্ধু নই, তবে বন্ধুস্থানীয়। শহীদ কাদরীর মতো প্রাণবন্ত মানুষ, বাংলাভাষায় বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার হাসি, উচ্ছ্বাস কিংবা কথা বলার ঢঙ, একেবারেই আলাদা এবং বাঙালীদের তুলনায় অনেক বেশি আন্তর্জাতিক বোধে তিনি উদ্দীপ্ত ছিলেন, জারিত ছিলেন। তিনি সব সময় নিজেকে সর্বদেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবতেন। এরকম বাঙালী কবিদের মধ্যে খুবই কম দেখা যায়। একই সঙ্গে দেশীয়, আন্তর্জাতিক একই সঙ্গে ঘরোয়া, একই সঙ্গে পারিবারিক, একই সঙ্গে সার্বজনীন। যদি তার সঙ্গে আড্ডায় মশগুল হতে পারা যায়, তিনি ভেতর থেকে কতটা অন্তরঙ্গ, কতটা আত্মিক এবং সব মিলিয়ে শহীদ কাদরী- তিনি তার কবিতার মতোই, ছড়ানো ছিটানো এবং একই সঙ্গে অন্তর্গত। তাকে পড়লে তার কবিতা পড়লে তাকে চেনা যায়, তার সমাজকে চেনা যায়, তার দেশকে চেনা যায় এবং তার বিশ্বকে চেনা যায়। সর্বোপরি গোটা বিশ্বকে চেনা যায় তার কবিতা পড়লে। কেননা তার মতো স্মার্ট আধুনিক কবি বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে’র পরে আর কেউ নেই। এবং এইটাই আমাদের কাছে বড় রকম অভাববোধ, যদিও তিনি খুব কম লিখেছেন, কিন্তু এই কম লেখাটাই যে আসলে অনেক বেশি লেখা, অনেক বড় রকমের লেখা। ৫০টি কবিতার বই লিখে তো লাভ নেই। টিএস এলিয়ট ৮২টি কবিতা লিখেছেন, যথেষ্ট। শহীদ কাদরী সব মিলিয়ে দুই শ’ কবিতাও লিখেননি, দেড় শ’ কবিতাও লিখেননি। কিন্তু বাংলাভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে তিনি থাকবেন। কারণ তার কবিতা হচ্ছে আমরা-আপনায় মিলে তার কবিতা, জনগণের কবিতা, জনমানুষের কবিতা, দেশের কবিতা এবং বিশ্বের কবিতা। সেই মানুষ তিনি, তিনি বিশ্বের মানুষ, পাঠককে তিনি বৈশ্বিক করতে চেয়েছেন। সেই বোধটাই আমাদের মাঝে দিয়েছেন নানাভাবে। উনি যখন ঢাকায় ছিলেন সিদ্ধেশ্বরীতে। তখন প্রায়ই যেতাম তার কাছে। তার সঙ্গে আড্ডা হতো, যদিও তিনি বয়সে বড়। প্রথম প্রথম ওই আড্ডায় বসার সৌভাগ্য হয়নি। পরের দিকে সেখানে বসতাম। সেখানে মানুষের হইচই, সবকিছুকে তিনি তুচ্ছ মনে করতেন এবং বেপরোয়া। ভাবে-ভঙ্গিতে সবসময় তিনি বেপরোয়া এবং এই বেপরোয়া ভাবটাই তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে। এই চিহ্নতকরণের মধ্যেই শহীদ কাদরী যেন একক হয়ে গেছেন। তারপরই হচ্ছেÑ আপনি ধরুন, সেই ষাটের দশকের কথা। তার পরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে খুব কম। ধরুন সেভেনটি থ্রিতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। প্রায়ই তার বাড়িতে যাচ্ছি, সন্ধ্যার সময় নয়, দুপুরে-সকালে যখন তিনি অফিসে যাচ্ছেন, না তখনও। তার পরে নানা রেস্তরাঁয় দেখা হচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছেন। নিউইয়র্কে, তিনি যখন বস্টনে ছিলেন, তখনও দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে। তারপর নিউইয়র্কে গত বছর, তার আগের বছর গিয়ে দু’তিন সন্ধ্যা কাটানো, আড্ডা দেয়া, খাওয়া-দাওয়া। তার সিগারেট খাওয়া নিষেধ। আমি যখন সিগারেট খাচ্ছি তখন তিনি বলছেন- ঠিক আছে, তুমি আমাকে খানিকটা সিগারেট দেবে? কিন্তু এটা তার নিষেধ। কিন্তু আমি সিগারেট খাচ্ছি, তিনি লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। যখন নীরা ভাবী পাশে থাকছেন না, দুটো টান দিয়ে রেখে দিচ্ছেন। যখন ভাবী আসছেন- বলছেন, তোমার ভাবী এসে গেল, নাও সিগারেটটা তুমি টানো। যখন তাকে নিয়ে কবিতার কথা হচ্ছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে। কারণ লোকে ভুলে গেছে আসলে, তিনি আসলে ভেতর থেকে বামপন্থী। তিনি যদিও মার্কিন দেশে থাকেন, তিনি সত্যিকারে বামপন্থী, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তার যে চর্চা, কবিতা বলুন, প্রবন্ধ বলুন, ইতিহাস বলুন, আন্তর্জাতিক বিষয় বলুনÑ তিনি প্রচ- লেখাপড়া করেন। তার বোধটাই হচ্ছে বামপন্থার বোধ। এটা হতে পারেÑ তার সমসাময়িক যে কবি তারা বামপন্থী। ঢাকায় তিনি চাকরি করতেন সোভিয়েত ইনফরমেশন সেন্টারে। সেই ঘোরটাও হতে পারে। তার চাইতে বড় কথা হচ্ছে যে, তার সমস্ত কবিবন্ধুরা বামপন্থায় বিশ্বাস করতেন। তিনি আমেরিকায় যাওয়ার পরেও, বিশেষ করে আমেরিকায় যাওয়ার পর আমেরিকায় এই চাকচিক্য হোক আর যাই হোক, অর্থনীতির দিক থেকে চাকচিক্যের দিক থেকে কিন্তু আসলে যে আগ্রাসী একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশ ভেতরে ভেতরে যে বোধ সম্পন্ন লোক, তিনি আসলে তা বুঝতে পারতেন। এটা নিয়ে আমার সঙ্গে খুবই কথাবার্তা হতো, যেহেতু আমার কবিতায় বামপন্থী একটা বিষয় থাকে এবং আমি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং সেটা সোচ্চারভাবেই বলা হয়। আমেরিকাকে আক্রমণ করতে গেলে আমি যখন আক্রমণ করি সেটা সরাসরিভাবেই করি। তিনি যখন আমার কবিতা পড়েন তখন বলেন, হ্যাঁ, এগুলোই আমরা বলতে চেয়েছি। এরকম আড্ডা আরকি। তিনি দেশ থেকে যেটা চেয়েছিলেন হয়ত সেটা পাননি। যেটা আশা করেছিলেন, যেটা না পাওয়ার একটা কারণ আছে। তার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে। দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে ওখানে থেকে তিনি যেটা চেয়েছেন, কখনও কখনও উনি চাইবেন, তার আশা ছিল দেশ তাকে কখনও না কখনও ডাকবে। কিন্তু সেটা আসলে কেউ বলেননি। সরকার বলেনি, বিরোধী দল বলেনি, রাজনৈতিক নেতারা বলেননি, এমনকি লেখক গোষ্ঠীও বলেননি। এটাই আসলে তার ভেতর যে একটা অভিমান তৈরি হয়েছিল- সেটা বড় হয়ে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি বাংলা সাহিত্য বেশি পড়তেন, বাংলা কবিতা বেশি পড়তেন। তার সবচাইতে প্রিয় কবি জীবনানন্দের চাইতেও প্রিয় কবি হচ্ছে অমিয় চক্রবর্তী। কেননা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে যে আন্তর্জাতিকতার বোধ, বেদনা, দ্বেষ সেটি তাকে আক্রান্ত করেছিল। জীবনানন্দও তিনি পড়তেন, কিন্তু সেই অর্থে বিষ্ণু দে যতটা পড়তেন, বুদ্ধদেব বসু অতটা পড়তেন না। কিন্তু অমিয় চক্রবর্তী পড়তেন। তার ভেতরে যে বোধ ছিল নির্বাসনের বোধ, কিন্তু তাকে তো ওইভাবে ডাকা হয়নি। ডাকাও হয়নি, বলাও হয়নি। শহীদ কাদরী খুবই অসুস্থ ছিলেন, বাংলাভাষার এরকম একজন শ্রেষ্ঠতম কবি, কেউ তার খোঁজও নেন না, দেখাও করেন না। এ কষ্টটা তার মধ্যে থাকতেই তো পারে। তাই না? সূত্র : বিডিনিউজ
×