ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কোরবানির ঈদের আগে চল্লিশটি সরানোর প্রস্তুতি;###;বাকি একশ চৌদ্দটির দৈনিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েই হাজারীবাগে চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার সিদ্ধান্ত

বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১ আগস্ট ২০১৬

বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী

এম শাহজাহান ॥ সাভারের ট্যানারিপল্লী প্রস্তুত না হওয়ায় আগামী কোরবানি ঈদের চামড়া হাজারীবাগেই ঢুকবে। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৪০টি ট্যানারি ঈদের আগে সাভারে সরে যাওয়ার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাকি ১১৪টি ট্যানারি হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। পরিবেশ দূষণের দায়ে হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত না হওয়ায় আদালতের নির্দেশে ১৫৪ ট্যানারি শিল্পকারখানাকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এই জরিমানা দিয়েই হাজারীবাগে কোরবানির চামড়া আনবেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। ট্যানারি সরাতে টালবাহানা করায় রবিবার ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা-২০১৬’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসন্তেুাষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, হাজারীবাগ থেকে যাতে না সরতে হয় সেজন্য ট্যানারি মালিকরা নানা ‘ছল-চাতুরী’ করছেন। চামড়া ব্যবসায়ীদের অযথা দেরির সমালোচনা করে তিনি দ্রুত ট্যানারি সাভারে সরানোর আহ্বান জানিয়েছেন। জানা গেছে, পরিবেশ দূষণের দায়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইতোমধ্যে হাইকোর্ট ১৫৪টি ট্যানারিকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে। পরবর্তীতে এই টাকা কমিয়ে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে লিভ টু আপীলের নিষ্পত্তি করেছে আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধেও রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, ট্যানারি স্থানান্তরের জটিলতা সামনে এনে কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে দিতেও আবার ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন উদ্যোক্তারা। এ কারণে আগামী কোরবানির চামড়া পাচারেরও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্রমতে, ১৫৫টি ট্যানারির পক্ষ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হতে বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর প্লট বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের ২০০ সদস্য থেকে ১০৫ প্লট এবং ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা নিয়েছেন ৫০ প্লট। বরাদ্দকৃত ১৫৫টি শিল্প ইউনিটের মাত্র ১ তলার ছাদ ঢালাই করেছে আংশিকসহ মাত্র ৪৩টি ট্যানারি। মাত্র ১৩টি কারখানা দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। বেস ঢালাই শেষ করে গ্রেটবিম ও কলাম ঢালাই করেছে ২৬টি কারখানা। এই বাস্তবতায় আরও এক বছরের মধ্যে সব ট্যানারি পুরোপুরি স্থানান্তরিত হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রথম তলা সম্পন্ন করে যেসব ট্যানারি ড্রাম বসানোর (ডোল) কাজ শুরু করেছে তাদেরও অন্তত ছয়মাস সময় লাগবে ট্যানারিগুলোর চামড়া প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপের কার্যক্রম শুরু করতে। ট্যানারি স্থানান্তরের অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) প্রকল্প পরিচালক মোঃ আবদুল কাইয়ুম জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বিসিকের শতভাগ প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির সংযোগের মূল লাইনের কাজও শতভাগ শেষ। এখন ট্যানারির মালিকরা শাখা লাইনের সংযোগ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। এই কাজটি তাদের শেষ করতে হবে। এটা তাদের দায়িত্ব। এদিকে, ট্যানারির মালিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, সারা বছর সংগ্রহ করা মোট চামড়ার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই সংগ্রহ হয় কোরবানির ঈদে। গত বছর কোরবানিতে প্রায় ৫৮ লাখ গরু-মহিষ ও ৩২ লাখ খাসি, বকরি ও ভেড়ার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এবার এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এসব চামড়া এবারও হাজারীবাগেই প্রক্রিয়াজাত করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যদিও ট্যানারি স্থানান্তরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশবাদীদের চাপ ও আদালতের রায়ে জরিমানার নির্দেশের পরও সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে স্থাপনা নির্মাণকাজ এগোচ্ছে ঢিমেতালে। এদিকে, বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্যমতে, গত কোরবানির ঈদে সারাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৬০ লাখ পিস চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য তৈরি ও রফতানি করা হয়েছে, কিন্তু এখনও গত বছরের প্রায় ৪০ লাখ পিস চামড়া মজুদ রয়েছে ট্যানারিগুলোতে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের প্রচুর পরিমাণে চামড়া মজুদ থাকায় এবার ট্যানারি মালিকদের কাঁচা চামড়া কেনার আগ্রহও কম। এছাড়া হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরজনিত সমস্যা তো রয়েছেই। এসব কারণে কোরবানির কাঁচা চামড়া পাচারের আশঙ্কাই বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, কোরবানির আগে হাজারীবাগ থেকে সাভারে সব ট্যানারি যেতে পারবে না। এ জন্য আরও সময় লাগবে। তিনি বলেন, কোরবানির কাঁচা চামড়া সাভারে নিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণে সর্বোচ্চ ৪০টি কারখানা জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাক কী হয়। বাকি ১১৪টি কারখানা হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করবে। চামড়া শিল্পের সংগঠনগুলো থেকে আপাতত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণের দায়ে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হচ্ছে। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রায়ের কপি হাতে আসার পর আইনী প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। জানা গেছে, সারা বছরে যত পশুর চামড়া পাওয়া যায় তার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ আসে কোরবানির ঈদের সময়। তাই কোরবানির ঈদ ঘিরে ট্যানারি মালিকদের বাড়তি প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। ট্যানারি স্থানান্তরে মালিকদের যথেষ্ট কার্পণ্য রয়েছে। এই ইস্যুকে সামনে রেখে কাঁচা চামড়ার দাম কমাতে নানা ধরনের ফন্দিফিকির তাদের রয়েছে। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-গত বছরের প্রায় অর্ধেক চামড়া এখনও রয়ে গেছে। এছাড়া সাভারের ট্যানারিপল্লীতে কারখানা নির্মাণ কাজের অর্থ যোগাতে গিয়ে মালিকদের হাতে নগদ অর্থ শেষ হয়ে গেছে। গত কোরবানির ঈদের আগে চামড়া কেনার জন্য ব্যাংকগুলো ৪০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছিল। কিন্তু গতবারের ঋণ অনেক ট্যানারি মালিক পরিশোধ করতে পারেননি, ঋণখেলাপী হয়ে পড়েছেন। আগে-ভাগে এসব নানা ধরনের কথাবার্তা বলে সরকারের সফ্টকর্নার পেতে চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে, গত বছর ঈদের সময় থেকে সরকার হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ওই সময় ব্যবসায়ীরা যাতে কাঁচা চামড়া হাজারীবাগে না নিয়ে সাভারের ট্যানারিপল্লীতে নিয়ে যায় তার জন্য হাজারীবাগে পুলিশ পাহারাও বসানো হয়। কিন্তু তারপরও থেমে ছিল না, হাজারীবাগে ঢুকেছে কাঁচা চামড়া। হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশের সে নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল। তবে এটাও বাস্তবতা যে, প্রতিদিনই পশুর চামড়া ঢুকছে হাজারীবাগে। এছাড়া ১৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অনুমোদন-সংক্রান্ত সভায় শিল্প সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আসন্ন কোরবানি ঈদে পশুর চামড়া সাভারে প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। এবার সর্বশেষ টার্গেট দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরাও সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঈদের পর আর হাজারীবাগে কাজ করতে দেয়া হবে না। সর্বসম্মতভাবেই এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারি স্থানান্তরে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। নির্ধারিত সময়ে তা না হওয়ায় হাজারীবাগে কাঁচা চামড়ার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। নিষেধাজ্ঞা ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হলেও সময় বেঁধে তা আবারও শিথিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শিল্পের একজন উদ্যোক্তা বলেন, হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিলে কোরবানির চামড়া কারা কিনবে তা জানা নেই। তখন প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম হবে ২০০-৩০০ টাকা। আর এটা নিশ্চিত যে তখন শতভাগ চামড়া পাচার হতে পারে। তিনি বলেন, একটি ট্যানারিও হাজারীবাগে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু আমরা বাধ্য। ট্যানারি স্থানান্তর সময়সাপেক্ষ বিষয়। এটি সহজ কোন বিষয় নয়। জানা গেছে, ট্যানারি মালিকদের চেয়ে সরকারী কাজের অগ্রগতি হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারও (সিইটিপি) এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়নি। সিইটিপির চারটি মডিউলের মধ্যে দুটির কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি দুটির মধ্যে একটির ৩০ শতাংশ এবং অপরটির ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই দুটি মডিউলের কাজ শেষ হতে এখনো প্রায় ৬ মাস লাগবে বলে জানিয়েছেন বিসিক কর্মকর্তারা। তবে কোরবানি ঈদের আগে যাতে ট্যানারিপল্লীর আংশিক কারখানা চালু করা যায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিসিক ও ট্যানারি মালিকরা। পুরো সিইটিপি চালু করতে প্রতিদিন দরকার হবে ২৫ হাজার গ্যালন বর্জ্য। আর সিইটিপির আংশিক চালু করতে দরকার পড়বে সাড়ে ১২ হাজার গ্যালন ট্যানারি বর্জ্য। আর এই বর্জ্য সরবরাহের জন্য বড় আকারের ৪৮টি ট্যানারি কারখানার চালু থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কোরবানি ঈদের আগে কোনভাবেই ৪০টির বেশি কারখানা চালু হচ্ছে না।
×