ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপন্ন হতে যাচ্ছে লাউয়াছড়ার

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৪ জুলাই ২০১৬

জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপন্ন হতে যাচ্ছে লাউয়াছড়ার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ হাজার গাছ কেটে রেলপথ চলাচলের উপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হলে এ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে দেশের চিরহরিৎ বনের মধ্যে একমাত্র লাউয়াছড়াই নমুনা হিসেবে এখনও টিকে আছে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের অবাধ ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করার নামে এ বনাঞ্চল উজাড় করা হলে গোটা এলাকার সার্বিক পরিবেশের ওপর বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলেন, চিরহরিৎ এ বনে নিরীক্ষীয় অঞ্চলের রেন ফরেস্টের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এ বনাঞ্চলের কারণে এখানে প্রতি বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে। এক সময় বৃহত্তর সিলেটে এ ধরনের বনাঞ্চলে পরিপূর্ণ থাকলেও কালের পরিক্রমায় তার চিহ্নটুকু নেই। এখন বনটি কোনরকমে টিকে রয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা বাগান সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমাণ জনসংখ্যার চাপ এবং নির্বিকারে গাছ কাটার ফলে মাত্র কয়েকটি স্থানেই চিরহরিৎ এই বনের অস্তিত্ব রয়েছে। লাউয়াছাড়ার প্রভাবেই এখনও শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে এ বনের মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি। মাটিতে প্রচুর পাথরও দেখা যায়। বনের মাটিতে পাতা জমে পুরু স্পঞ্জের মতো হয়ে থাকে। বনের ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো পাহাড়ী ছড়া। এসব ছড়া দিয়েই হাইল হাওড়, বাইক্কা বিল, গোপলা নদীসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জলাশয়কে বছরব্যাপী পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। তাই বনের সঙ্গে এ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কযুক্ত। সিলেট অঞ্চলের পরিবেশবিদ ও পরিবেশ সংগঠন বাপার সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, দেশের চিরহরিৎ বনের মধ্যে লাউয়াছড়াই নমুনা হয়ে টিকে থাকলেও এ বন আজ সর্বাংশে বিপন্ন হতে চলেছে। অবাধ ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করার নামে রেলওয়ে এ বনাঞ্চলের ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে যা এ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলবে। তিনি বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেশের অন্যতম সাতটি বন্যপ্রাণী অভায়রণ্য ও দশটি জাতীয় উদ্যানের অন্যতম। ১৯৯৬ সালে এই বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ এই বন নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র এতদাঞ্চলের বাসিন্দাসহ সমগ্র সিলেট ও বাংলাদেশের জনগণ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতিপ্রেমীদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন শুধু রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়, এই বনে এর আগেও একের পর এক আঘাত এসেছে। ১৯৯৭ সালে ১৪ জুন লাউয়াছড়ার পাশেই মাগুরছড়ায় বহুজাতিক তেলগ্যাস কোম্পানি অক্সিজেন্টাল পরিচালিত অনুসন্ধান কূপে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরিত হয়। যা পুরো এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এ বিস্ফোরণের ফলে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে যায়। মাগুর ছড়ার বন এখনও সেই ক্ষত বহন করে চলেছে। এই ক্ষত শুকানোর আগেই ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে বহুজাতিক তেলগ্যাস কোম্পানি শেভরন লাউয়াছড়া ও এর আশপাশে বনভূমি এলাকায় অনুসন্ধান কাজ শুরু করে। এই অনুসন্ধান কাজের জন্য বনের অভ্যন্তরে ও আশপাশে এলাকায় নির্বিচারে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় বন এলাকায় সৃষ্ট ভূকম্পনের ফলে বন্যপ্রাণী ও স্থানীয় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বনের কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়। বন থেকে বন্যপ্রাণীও পালাতে শুরু করে। অথচ এই লাউয়াছড়া বনই দেশে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জাতীয় উদ্যান। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের এই বন ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ১৭ প্রজাতির কীটপতঙ্গ এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। বিলুপ্ত উল্লুকের জন্য এই বন এখনও বিখ্যাত। এটি ছাড়াও এই বনে রয়েছে বিরল প্রজাতির মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, উড়ুক্কু কাঠবিড়ালী, হলুদ পাহাড়ী কচ্ছপসহ মহাবিপন্ন তালিকায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রাণী গবেষক এ বনে ব্যাঙ, টিকটিকি, সাপের বেশ কয়েকটি নতুন প্রজাতিও আবিষ্কার করেছেন। লাউয়াছড়ার পূর্বে পশ্চিম ভানুগাছ, সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের অংশ ছিল। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিম ভানুগাছ বনের লাউয়াছড়া বিটের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংশোধনী আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এবং বনের ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগের প্রতিবাদে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, লাউয়াছড়া আজ আর বন নেই, এটি বাগান ও পার্কে পরিণত হয়েছে। বন বিভাগের গাফিলতি, দুর্নীতি ও ভুলনীতির কারণে লাউয়াছড়াসহ অনেক বন আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রাকৃতিক বনকে নিজস্ব চরিত্রে গড়ে উঠতে দিতে হবে এবং সহ-ব্যবস্থাপনার নামে প্রতারণা বন্ধ করতে হবে। বন বিধ্বংসী সকল পদক্ষেপ বন্ধ করার পাশাপাশি বন বিভাগকে ঢেলে সাজার আহ্বান জানান তিনি। অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য হওয়ার পরও একে ধ্বংসের যে চেষ্টা চলছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই জাতীয় সম্পদ যাতে বিনষ্ট না করা হয় সেজন্য নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বনকে ধ্বংস করে যাতে কোন উন্নয়ন চিন্তা না করা হয় সে বিষয়ে অবশ্যই অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। লাউয়াছড়ার জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে অবাধে পর্যটকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, লাউয়াছড়া নিয়ে বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও লুটপাট চলছে দীর্ঘদিন থেকে। সম্প্রতি রেলপথ উন্নয়নের নামে গাছ কাটার যে প্রক্রিয়া মূলত লুটপাটের একটি ষড়যন্ত্র। লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে যে সময় রেলপথ ও সড়ক পথ তৈরি হয়েছে, তখনকার প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট মোটেও এক নয়। যদিও শুরু থেকেই রেলপথ ও সড়ক পথ লাউয়াছড়ার জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারপরও তখন অল্পসংখ্যক যানবাহন চলাচল করত, এখন তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। যার ফলে এই বনে বসবাসরত জীববৈচিত্র্যের জন্য এই পথ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
×