ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন ;###;এক ভরি স্বর্ণের ;###;বিনিময়ে ভারত দেয় ১৫০ বোতল ফেনসিডিল

কুড়িগ্রামে মাদকের রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৮ মে ২০১৬

কুড়িগ্রামে মাদকের রমরমা বাণিজ্য

রাজুমোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রাম জেলার শতাধিক স্পটে মাদকের রমরমা ব্যবসা। প্রতিদিন কোটি টাকার বাণিজ্য। জেলার ২৭৩ কিমি সীমান্ত গলে ভারত থেকে অবাধে আসছে মদ, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মরণনেশা। বিনিময়ে ভারতে যাচ্ছে স্বর্ণ। এক ভরি স্বর্ণের বিনিময়ে মেলে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল। ফলে সংক্রামক ব্যাধির মতো মাদক নেশা জড়িয়ে পড়েছে কুড়িগ্রাম জেলার সর্বত্র। নেশার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে গোটা যুবসমাজ। এগুলোকে ঘিরে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। ঘটছে সহিংস ঘটনা। বেড়ে গেছে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং রাহাজানি। মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে অভিভাবক মহল। এক উদ্বেগজনক তথ্যে জানা যায়, জেলায় প্রায় ৬ হাজার উঠতি বয়সের তরুণ/যুবক নিয়মিত ফেনসিডিল সেবন করে। তাদের প্রতিদিন প্রয়োজন হয় একটি থেকে পাঁচটি। এক বোতল ফেনসিডিলের মূল্য ৮শ’ টাকা হলে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়। এছাড়া হেরোইন এক পুড়িয়া ২০০ টাকা, ইয়াবা প্রতিপিচ ১৫০ টাকা, গাঁজার কেজি ১০ হাজার টাকা। ফেনসিডিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাংলা মদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের অবস্থা ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’। তাদের অস্ত্র দেয়া হয় না। অস্ত্র ছাড়া মাদক সংক্রান্ত কোন অভিযান পরিচালনা করা দুঃসাধ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদকসেবীদের তালিকায় বৃহৎ অংশে রয়েছে ছাত্র, বেকার যুবক এমনকি কতিপয় শিক্ষক, সাংবাদিক, সরকারী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। মাদকসেবীদের চাহিদা অনুযায়ী কোটি টাকার ওপরে প্রতিদিন মাদকের ব্যবসা চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাদক ব্যবসায়ী জানায়, ভারত স্বর্ণের পরিবর্তে ফেনসিডিল দিতে আগ্রহী। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক রায়হান আহমেদ জানান, স্বর্ণের পরিবর্তে ফেনসিডিল আসে বিষয়টি শুনেছি। কুড়িগ্রামে প্রায় শতাধিক স্পটে মাদকের ব্যবসা রয়েছে। এছাড়াও ভ্রাম্যমাণ কিছু মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। স্পটগুলোতে কারা ব্যবসা করেন তার তালিকা উল্লেখ করে বলেন, মাদকের বিভিন্ন মামলার তথ্যমতে, কুড়িগ্রাম শহরে হেরোইন সরবরাহকারী মিলন। শহরের গড়েরপাড়, চামড়ার গোলা, ভেলাকোপা ও শুল্কুর বাজারে যৌথভাবে শেখ সাদি, চান্দু, রফিকুল ব্যবসা করে। আমবাড়ির ঘাটে সেলিম, উলিপুর শহরে মমিনুল, মিলন ও মনি। কুড়িগ্রাম শহরে পরিত্যক্ত রেলস্টেশনে মালা, নাগেশ্বরী বাজারে মনু ও মুক্তা। ভুরুঙ্গামারীতে অপু, মুন্না এবং এদের তত্ত্বাবধানে আরও ৫ জন কাজ করে। ফুলবাড়ির জুম্মার মোড়ে শাহানুর ও মম মদ বিক্রি করে। মাদক শুধু শহরে আসে না। মাদক সীমান্ত পেরিয়ে সড়ক পথে বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক, ভ্যান-লরিতে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। এছাড়া নৌ-পথে যাত্রাপুর, রৌমারী হয়ে এবং চিলমারী-গাইবান্ধা হয়ে মাদক দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। জনবলের অভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তিনি আরও জানান, ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম মহকুমা জেলা হিসেবে উন্নিত হওয়ার ১০ বৎসর পরে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে রৌমারী উপজেলায় ব্যাপকহারে গাঁজার চাষ শুরু হয়। গোটা জেলায় এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গাঁজার চাষ এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকল্পে ১৯৯৪ সালেই কুড়িগ্রামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কুড়িগ্রাম সার্কেল গঠিত হয়। এ সার্কেলের অধীন ১৩ জন জনবলের মধ্যে বর্তমানে আছে মাত্র চারজন। এর মধ্যে সহকারী পরিচালক, পরিদর্শক, এএসআই, অফিস সহকারী মিলে চারজন থাকলেও শূন্য রয়েছে একজন এসআই, তিনজন সিপাহি, ওয়্যারলেস অপারেটর একজন, গাড়িচালক একজন, দারোয়ান একজন, এমএলএসএস একজন ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী একজন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কুড়িগ্রাম সার্কেলের অধীনে রয়েছে কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, রাজিবপুর এবং রৌমারী এই ৯টি উপজেলার ২ হাজার ২শ’ ৯৬ বর্গ কিমি বিশাল এলাকা। এই অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে আরও পদ সৃষ্টি করা দরকার হয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্য অধিদফতর কুড়িগ্রাম সার্কেলের গাড়ি নেই। গাড়ি না থাকায় অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে অথবা এ ধরনের অন্য কোন খবর পেয়েও সার্কেল থেকে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করার উপায় নেই। অবৈধ মাদকদ্রব্য বিক্রি, পাচার ও দেশীমদ প্রস্তুতের বহু খবর বিভিন্ন সোর্স মারফত এলেও পুলিশের অভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। পুলিশের জন্য জেলা পুলিশ দফতরে খবর পাঠিয়ে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় পুলিশ পাওয়া যায় না। পুলিশ অফিস হতে জানানো হয় তাদের কাছে সেদিন অতিরিক্ত পুলিশ নেই। কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার ডাঃ তবারক উল্লাহ্ মাদকের ব্যাপক বিস্তারে উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, পুলিশ বসে নেই। সর্বশক্তি দিয়ে পুলিশ প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীদের আদালতে সোপর্দ করছে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে তারা আবারও জড়িয়ে পড়ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণের আন্দোলন পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সন্তানরা কোথায় যায়, কী করে, খোঁজ নেবেন না; আর পুলিশকে বলবেন দেশটা ভাল করে দাও, এটা হতে পারে না। নিজ সন্তানদের খোঁজখবর রাখুন। দেখবেন মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাদক যখন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে তখন পুলিশকে নিয়ে নানান অভিযোগ আসে। তবে যৌথ উদ্যোগে জনগণ, বিজিবি, জেলা প্রশাসন, পুলিশ কাজ করলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব।
×