ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন নূরজাহান বেগম

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৭ মে ২০১৬

চলে গেলেন নূরজাহান বেগম

বাংলাদেশের নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ, নারীদের জন্য প্রথম মহিলা সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম ২৩ মে সোমবার সকাল ১০টায় স্কয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের নারী জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। ১৯২৫ সালে তাঁর জন্ম। ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে। এরপর কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। নূরজাহানের বাবা ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের হাত ধরেই ১৯৪৭ সালে মহিলাদের জন্য প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার যাত্রা শুরু। ’৪৭ এর দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে ‘বেগম’ এর কার্যক্রম চলে আসে ঢাকায়। বেগম সুফিয়া কামাল প্রথম দিকে বেগম এর সম্পাদক থাকলেও ঢাকায় বেগমের চতুর্থ সংখ্যা বের হওয়ার পর থেকে নূরজাহান বেগম এ সাপ্তাহিকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এভাবেই নূরজাহান বেগমের প্রত্যয়ী সম্পাদনায় বেগম দেশের একটি প্রখ্যাত মহিলা সাপ্তাহিকের মর্যাদায় আসীন হয়। দেশ বিভাগের চরম সঙ্কটের মধ্যেও নূরজাহান তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কখনই পিছপা হননি। আমরা জানি এর পরপরই শুরু হয় (১৯৫২ সাল) আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন এরই পথ পরিক্রমায় ’৪৭ এর দেশ বিভাগ আমাদের জন্য কোন ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনেনি। সব মানুষের জীবন যখন সংগ্রামের লাল বেড়িতে শৃঙ্খলাবদ্ধ সেখানে দুর্বল অংশ হিসেবে নারীজাতির অবস্থা যে কত অসহায় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই মুহূর্তগুলো নূরজাহান বেগমের অদম্য নির্ভীকতা, সচেতন প্রত্যয়ের অনমনীয় দৃঢ়তা এবং সৃজনশীল নারী সংস্কৃতি সেবীদের প্রতি তাঁর একান্ত মনোনিবেশ ‘বেগম’ পত্রিকার মতো একটি মহিলা সাপ্তাহিকের গতিপথ সবসময়ই অবারিত থেকেছে সাহসী পদক্ষেপে, কঠিন প্রত্যয়ে, দৃঢ় ব্যক্তিত্বে তিনি মহিলা সাহিত্যিকদের নিয়ে এগিয়ে যান বিপদশঙ্কুল সব পথকে অতিক্রান্ত করে। আর তাই বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামালের পরই যাঁর নাম অলঙ্কৃত হয়ে আছে তিনি ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম। ১৯৫৪ সালে ‘বেগম’ পত্রিকার নিজস্ব কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো সমমনা মহিলা সংস্কৃতি সেবীদের নিয়ে একটি যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠান ‘বেগম ক্লাব’। তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থার আলোকে এই ‘বেগম ক্লাবে’র মাত্রাও কোনভাবেই সহজ ছিল না। প্রথম দিকে বেগম সুফিয়া কামাল এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকলেও পরবর্তীতে নূরজাহান বেগমই এর পুরো দায়ভার গ্রহণ করেন। সুতরাং বাংলাদেশের অগ্রসরমান নারীর বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনের নূরজাহান বেগম যেভাবে সামনে চলার পথকে অবাধ ও মুক্ত করেছেন তা সত্যিই অতুলনীয়। অকুতোভয় এই মহীয়সী নারী সাপ্তাহিক বেগমের প্রতিটি সংখ্যা নিয়মিত বের করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের অনেক খ্যাতনামা নারী সাহিত্যিক বেগমের হাতধরেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। নারী শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময়ে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। তার মধ্যে ১৯৯৭ সালে রোকেয়া পদকে ভূষিত হন তিনি। ২০১১ সালে সাংবাদিকতায় কৃতিত্বের জন্য তাঁকে একুশে পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জোবুন্নেসা মাহ্বুবউল্লাহ্ ট্রাস্ট, রোটারী ক্লাব তাঁকে সম্মাননা জানায়। এই গরীয়সী নারী ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের নারী জাগরণের অন্যতম পুরোধা, সংস্কৃতিমনা নারী জাতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক নূরজাহান বেগমকে আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। এই বলিষ্ঠ নারী নেতৃত্বেও আসলে কোন মৃত্যু নেই। অগ্রসরমান নারী জাতির দিশারী হয়ে তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
×