ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লোক সমাগম ও বিক্রি বেড়েছে- অভাব ভাবগাম্ভীর্যের

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

লোক সমাগম ও বিক্রি বেড়েছে- অভাব ভাবগাম্ভীর্যের

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা সেই বেদনাবিধুর স্মৃতির ধারক। আয়োজনটির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ এক মাস রফিক-শফিক-বরকতদের স্মরণ করার রীতি বহুকাল ধরে প্রচলিত। শুরু থেকেই বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির জয়গান করে এই মেলা। একুশের চেতনাকে লালন করে, প্রচার করে। এভাবে বই মেলা বঙ্গ সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মেলার সেই চরিত্র ও চেহারা ম্লান হয়ে আসছিল। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর বেলায় অবস্থাটির আরও অবনতি হয়েছে। ২৮ দিনের মেলা ঘুরে এমন ধারণা হয়েছে। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সমালোচনা হচ্ছিল মেলার বিভিন্ন দিক নিয়ে। বিদগ্ধজনরা এখনও সমালোচনায় মুখর। তারা বলছেন, সব ঠিক আছে অনেক বলেছি। অনেক বলা হয়েছে। কিন্তু এভাবে বলে কিছু আসলে অর্জন করা যাচ্ছে না। বরং ভুল ও অশুদ্ধ যত যা, সামনে চলে আসছে। স্থ’ূল অনেক কিছু বিশেষ গুরুত্বের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। তারা বলছেন, মূল মেলাটি ছিল বায়ান্নর চেতনার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। এ কারণেই আর সব মেলা থেকে এই মেলা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এখন যে মেলা দেখছি তাতে অমর একুশের ভাবগাম্ভীর্য যথেষ্টই অনুপস্থিত। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ার পর মেলা নিয়ে শুধু নিরীক্ষা হচ্ছে। এই নিরীক্ষার কোন পর্যায়ে একুশের ভাবগাম্ভীর্যকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে না। এবার মেলায় প্রবেশ করে মনে হয়েছে, বাণিজ্য মেলার সঙ্গে এর তেমন কোন বৈসাদৃশ্য নেই। গত ২৮ দিন মেলার মুখ ঢেকে ছিল বিজ্ঞাপনে। বিস্কুটের বিজ্ঞাপনের মডেলদের ছবি সাঁটা ছিল চোখের সামনে। বিশেষ করে মেলায় স্থাপিত নিরাপত্তা টাওয়ারের গায়ে এমন বিচ্ছিরিভাবে বিজ্ঞাপন লাগানো হয় যে, দেখে মনে হয় বাণিজ্য মেলা। মেলার বিশাল পরিসর। সেটা ব্যবহার করাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মেলায় স্টল এতো বেশি যে, গুনে শেষ করা যায় না। সারাবছর এইসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কোন খোঁজ থাকে না। নিজেদের প্রয়োজনে দুই দশটি নামমাত্র প্রকাশনা নিয়ে মেলায় চলে আসে। কেউ বাণিজ্য করতে আসে। কেউ আসে নিজেদের ব্যবসায়িক প্রচারণার জন্য। বাংলা একাডেমি তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে বলেই অভিযোগ। নিম্নমানের বইয়ের প্রকাশকরা মেলার বিশাল জায়গা দখল করে রাখায় ভাল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো খুঁজে বের করতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হচ্ছে। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশের এই চেতনা থেকেও একাডেমি সরে এসেছে বলে মনে করেন এমনকি ভাষা সংগ্রামীরা। তারা বলছেন, লেখকের মেলা লেখক হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়। প্রকাশকের মেলা প্রকাশক হত্যার বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটেছে। এই আপোস একাডেমি এবং মেলার মূল উদ্দেশ্যটিকে ব্যাহত করছে। এবারের মেলায় ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা মৌলিক ও গবেষণা গ্রন্থের অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। ভাষা আন্দোলনের ওপর বই এসেছে মাত্র দুটি। এর বাইরে মূল ধারার সাহিত্য কম এসেছে। জনপ্রিয় ধারার লেখকদের বই প্রকাশ ও বিক্রি হয়েছে বেশি। প্রতিবারের মতো এবারও মেলা প্রাঙ্গণে ভাষা শহীদ লেখক ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে কয়েকটি চত্বর করা হয়েছে। তবে, এই সব নাম ও প্রতিকৃতি মোটেও দৃশ্যমান নয়। বরং নামের বানান ভুল, গৌণ করে উপস্থাপনা। এবারও মেলায় লোকসমাগম ছিল উল্লেখ করার মতো। বিভিন্ন বয়সী মানুষ প্রতিদিন আসছেন। তবে, অনেক পরিচিত প্রিয়মুখ মেলায় আসেননি। এ তালিকায় আছেন লেখক প্রকাশক এবং আড্ডাপ্রিয় অনেক চেনা মুখ। এদের অনুপস্থিতি অনুভূত হয়েছে। অন্যদিকে, এবারই প্রথম এমন অসংখ্য মুখ দেখা গেছে মেলায় যাদের ভাব ভাষা পোশাক কিংবা আচরণের সঙ্গে এই মেলা সাধারণত অভ্যস্থ নয়। এমন আরও অনেক অসঙ্গতি অপ্রাপ্তির কারণে এবারের মেলা আলোচিত হচ্ছে। শেষ মুহূর্তের এই আলোচনা আজ সোমবার পর্যন্ত চলবে। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ডিজিটাল মুক্তিযুদ্ধের কৌশল শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাতীয় সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার, ড. মাহবুবুল হক এবং তারিক সুজাত। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। প্রাবন্ধিক বলেন, সার্বিক বিবেচনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ কেবলমাত্র প্রযুক্তির প্রয়োগ নয়, এটি বস্তুত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এর মূল লক্ষ্য একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। ধর্মভিত্তিক জঙ্গী রাষ্ট্র গড়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়া যায় না। বরং ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলনটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রবহমান ধারারই অংশ। এই ধারার দুই প্রান্তে যে দুই ধারার মানুষের অবস্থান করছে তার একটি সমীকরণ করা প্রয়োজন। খুব স্পষ্ট করে একটি বলা দরকার যে, এই রেখার একদিকে রয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং অন্যদিকে রয়েছে একাত্তরের বিজয়ীরা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লড়াইয়ের এই মাত্রাটি জনগণের মাঝে তেমনভাবে স্পষ্ট করা সম্ভব হয়নি। বস্তুত অব্যাহত প্রযুক্তিক ও সামাজিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের মাঝেই আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে আবৃত্তি সংগঠন ‘আবৃত্তিশীলন’ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাঙালী ফাউন্ডেশন’র শিল্পীরা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী অদিতি মহসিন, বুলবুল ইসলাম, ডাঃ অরূপ রতন চৌধুরী, লাইসা আহমেদ লিসা, মকবুল হোসেন, শারমিন সাথী ইসলাম, ছায়া রাণী কর্মকার, জান্নাত এ ফেরদৌসী, সেমন্তী মঞ্জরী এবং সুমা রাণী রায়। আজকের আয়োজন ॥ আজ সোমবার অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর সমাপনী দিন। মেলা শুরু হবে বেলা ২টার পরিবর্তে বেলা ১টায় এবং শেষ হবে যথারীতি রাত ৮টায়। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে রয়েছে নওয়াজেশ আহমেদ ও নাইবুদ্দিন আহমদকে স্মরণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন অধ্যাপক বুলবন ওসমান, শামসুল আলম এবং নাসিম আহমেদ নাদভী। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। সমাপনী অনুষ্ঠান ॥ সন্ধ্যা ৬টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর সমাপনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর সদস্য-সচিব ড. জালাল আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় অবদানের জন্য ফরাসি গবেষক ও অনুবাদক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও প্রবাসী বাঙালী কথাশিল্পী মন্জু ইসলামকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার-২০১৫ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হবে।
×