ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

কিছু কেন্দ্র দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা

মহেশখালীতে আশ্রয়কেন্দ্র সংকট ঝুঁকিতে লাখো উপকূলবাসী

নিজস্ব সংবাদদাতা, মহেশখালী

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২৬ জুলাই ২০২৫

মহেশখালীতে আশ্রয়কেন্দ্র সংকট ঝুঁকিতে লাখো উপকূলবাসী

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অবস্থা শোচনীয়। কোথাও ছাদ ফেটে পানি পড়ে

বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী বরাবরই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকার ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর সরকারিভাবে বিভিন্ন ইউনিয়নে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রের নেই সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, অনেকগুলো পরিত্যক্ত, আবার কিছু দখল হয়ে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে।
মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী, মাতারবাড়ি, কালারমারছড়া, হোয়ানক, শাপলাপুর ও ধলঘাটাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে সরেজমিনে দেখা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অবস্থা শোচনীয়। কোথাও ছাদ ফেটে পানি পড়ে, কোথাও দরজা-জানালা ভেঙে পড়ে আছে। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে এখন গোডাউন, গবাদিপশুর খামার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অতিবৃষ্টি হলেই ডুবে যায় কুতুবজোমের ঘটিভাঙ্গা, পৌরসভার চরপাড়া, ছোট মহেশখালীর মুদিরছড়া ও উম্বনিয়া পাড়া, বড় মহেশখালীর বরদিয়া, হোয়ানকের কালাগাজির পাড়া, ধলঘাটা ইউনিয়ন, মাতারবাড়ির সাইটপাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম। এত পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ২০ হাজার ও আশ্রয়হীন হয় দুই হাজারের অধিক মানুষ।
মাতারবাড়ি ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা কাইমুল ইসলাম ছোটন বলেন, ‘আমরা জানি ঘূর্ণিঝড় আসলে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে, কিন্তু আমাদের ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্র এখন গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে গেলে নিজেরাই আরও বিপদে পড়ি। সরকার যদি নতুন ভবন করে বা পুরোনোগুলো ঠিক করত, তাহলে আমরা অন্তত সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারতাম।’
মহেশখালীর আদি উপদ্বীপ হলো ধলঘাটা ইউনিয়ন। বঙ্গোপসাগরের কিনারায় এটি অবস্থিত। অতি জোয়ার হলেই এটি প্লাবিত হয়। এই ইউনিয়নে প্রায় দশ হাজার মানুষের বেশি বসবাস। কিন্তু ভালো আশ্রয়কেন্দ্র বলতে দুটি স্কুল ও একটি তলা আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়া কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নেই। ধলঘাটা ইউনিয়নের এক স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের স্কুলের পাশেই যে আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, সেটা এখন ব্যবহার অনুপযোগী। ফাটল ধরেছে, ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রায় ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কার্যকর আশ্রয়কেন্দ্র নেই।’
মহেশখালীর আরও একটি উপদ্বীপ হলো সোনাদিয়া। এটি সাগরের একবারে মাঝখানে। এই দ্বীপে দুই পাড়া মিলে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু দ্বীপের একমাত্র ভবনটি হলো স্কুল ভবন। সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘আমাদের স্কুলেই প্রায় ১২০ জন শিক্ষার্থী পড়ে। দুর্যোগের সময় তাদের নিয়ে কোথায় যাব আমরা? ভবনটি খুব নড়বড়ে। তাছাড়া সোনাদিয়া এলাকার মানুষজনের জন্য এর বিকল্প কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নেই।’
মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক জায়গায় দেখা গেছে আশ্রয়কেন্দ্র দখল করে রেখেছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। কেউ গরুর খামার করেছে, কেউ আবার পাটাতন লাগিয়ে ঘর বানিয়েছে। এসব বিষয়ে অনেকবার অভিযোগ জানানো হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেদায়েত উল্যাহ্ বলেন, ‘মহেশখালী একটি ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা। আশ্রয়কেন্দ্র ঘাটতির বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। ইতোমধ্যে কিছু পুরনো আশ্রয়কেন্দ্রের তালিকা করা হয়েছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি আরও জানান, ‘স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র দখল করে আছে, তাদের বিষয়ে আমরা খোঁজ নিচ্ছি এবং উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
স্থানীয় উন্নয়নকর্মী ও এক্টিভিস্ট রুহুল আমিন বলেন,‘মহেশখালীতে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষের বাস। কিন্তু কার্যকর আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৪০-৫০টি, যার অধিকাংশই জরাজীর্ণ। এই এলাকায় কমপক্ষে আরও ৫০টি আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন, যাতে একযোগে অন্তত এক লাখ মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে। দুর্যোগ প্রতিরোধে শুধু নতুন ভবন করলেই হবে না, সেগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা কমিটি গঠন ও জনসচেতনতা তৈরিও জরুরি।‘
মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, দুর্যোগের আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ সবসময় আতংকে থাকে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের মুদিরছড়া এলাকার গৃহবধূ হালিমা খাতুন বলেন,‘ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমাদের ঘরে পানি উঠে যায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাব- এই চিন্তায় রাত কাটে। আগের মতো আরেকটা বড় ঝড় আসলে কী হবে আল্লাহই জানে। আমরা শুধু চাই, একটা নিরাপদ জায়গা।‘
মহেশখালী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক আবুল বশর পারভেজ বলেন, মহেশখালীতে আশ্রয়কেন্দ্র সংকট এখন আর শুধু অবহেলা নয়, এটি একটি জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, প্রভাবশালীদের দখলদারি বন্ধ এবং স্থানীয়দের অংশগ্রহণে টেকসই পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি।’

প্যানেল হু

×