এক সময় বর্ষা এলেই নদীর বুকে ভেসে উঠত বাঁশি, ঢোল, আর নৌকার ছন্দ। এখন সে দৃশ্য শুধুই গল্পে, স্মৃতিতে।
বাংলা মানেই নদী। আর নদী মানেই ছিল জীবন। সেই জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল নৌকা বাইচ—যেটি শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, ছিল এক মহাউৎসব। বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্য আজ যেন কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে চেনা দৃশ্য
একসময় বর্ষা এলেই নদী-খাল-বিলে শুরু হতো প্রস্তুতি। লম্বা ছইওয়ালা বাইচ নৌকা তৈরি হতো গ্রাম্য কারিগরদের হাতে। দল গঠনের জন্য গ্রামে গ্রামে চলতো চর্চা, খেলার কৌশল, গানের তালমেল। গ্রামে মাইকে ঘোষণা, মেলায় সাজসাজ রব, ঢাকঢোলের তালে নদীর বুকে নাচত নৌকার সারি।
কিন্তু আজ আর তেমনটা দেখা যায় না। এখন বর্ষা এলেও নদীর বুক নীরব। নেই বাইচের প্রস্তুতি, নেই ঢাকের শব্দ। সময় বদলেছে, পাল্টেছে নদী, বদলে গেছে জীবনধারা।
কেন হারাচ্ছে এই ঐতিহ্য?
নদী হারিয়ে যাচ্ছে—অবৈধ দখল, ড্রেজিং, খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনে অনেক নদী আজ শুকিয়ে গেছে।
আয়োজক নেই—স্থানীয় প্রশাসন বা গ্রাম্য সমাজের ঐক্য এখন আগের মতো সক্রিয় নয়।
যুবসমাজের আগ্রহ কমে গেছে—প্রযুক্তি নির্ভর জীবনে মাঠ, নদী, খেলা এসব যেন দূরের জগৎ।
খরচ ও নিরাপত্তা—নৌকা বাইচ আয়োজন করতে এখন অনেক খরচ হয়, আবার দুর্ঘটনার ভয়ও থাকে।
স্মৃতিতে ফিরে আসে সেই দিনগুলো
বরিশাল, ভোলা,বরগুনা, পটুয়াখালী, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী বা নারায়ণগঞ্জের অনেক প্রবীণ মানুষ এখনো বলেন—"আগে বাইচের দিনটা ছিল ঈদের মতো। সকাল থেকেই মানুষ নদীপাড়ে ভিড় করতো। মেয়ে-শিশু-বৃদ্ধ সবাই থাকত সেই উৎসবে। এখন সবই কেবল স্মৃতি..."
সংস্কৃতি হারালে হারায় চেতনা
নৌকা বাইচ ছিল গ্রামীণ মানুষের প্রাণবন্ত বিনোদন। এতে ছিল ক্রীড়া, সংগীত, ঐক্য ও শিকড়ের সংস্পর্শ। এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া মানে কেবল একটি উৎসব নয়, বরং বাঙালির নদীকেন্দ্রিক জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক চেতনার ক্ষয়।
কি করা যায়?
স্থানীয় পর্যায়ে পুরস্কারভিত্তিক বাইচ আয়োজন করা।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসব ভাতা চালু।
টেলিভিশনে সম্প্রচার ও ইউটিউবে প্রচার বাড়ানো।
স্কুল-কলেজে ঐতিহ্যবিষয়ক পাঠ্যসূচিতে এসব অন্তর্ভুক্ত করা।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল শিকড়েই রয়েছে নদী আর নৌকা। সেই নৌকাই যদি বেঁচে না থাকে, তাহলে এই সংস্কৃতি কীভাবে টিকে থাকবে? নৌকা বাইচ কেবল ফিরে আসুক এমনটাই নয়, বরং বাঁচুক আমাদের হৃদয়ের ভেতর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
রাজু
