
এক সময় রাজশাহীর গ্রামীণ জনপথে রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ত সারি সারি গরু ও মহিষের গাড়ি। গ্রামের হাট-বাজার, ধানক্ষেত কিংবা বিয়ে বাড়ির পথে প্রতিদিন চলাচল করত শত শত গরু বা মহিষ টানা দু’চাকার গাড়ি। আধুনিক যানের অভাবে এই বাহনই ছিলো কৃষক ও সাধারণ মানুষের পরিবহনের একমাত্র অবলম্বন। ফসল, কাঠ, খড় বা মানুষ বহনের কাজে এইসব গাড়ির উপরই ছিল তাদের নির্ভরতা।
তবে সময়ের পরিবর্তনে সেই চিত্র এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। রাজশাহীর গ্রামীণ এলাকায় এখন আর আগের মতো দেখা মেলে না ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের গাড়ির। আধুনিক যন্ত্রপাতি, উন্নত সড়ক ব্যবস্থা আর ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারে মানুষ এখন অধিক গতিসম্পন্ন ও কম খরচে চলাচলের নতুন নতুন বাহনের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে একসময় মানুষের জীবনযাপনের অংশ হয়ে ওঠা এই গরু-মহিষের গাড়ি এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, পবা কিংবা বাগমারা উপজেলার গ্রামীণ চিত্রে গরুর গাড়ির শোভা ছিলো একদা খুবই সাধারণ। বর ও কনে গরুর গাড়িতে চড়ে বিয়ে বাড়িতে যেত—এটা যেনো তখনকার সময়ের একটা আবশ্যিক রীতি ছিল। বিয়ের মিছিল, শোভাযাত্রা, কিংবা জমির ধান-বিচাল বহনে গরুর গাড়িই ছিল সহজ ও নির্ভরযোগ্য বাহন। গরুর গাড়ি চালানোর কাজ করতেন ‘গাড়িয়াল’ নামে পরিচিত একদল পেশাজীবী। তারা ছিলেন দক্ষ ও অভিজ্ঞ। কিন্তু এখন আর সেই পেশাও টিকে নেই।
বর্তমানে রাজশাহীর গ্রামগঞ্জে দেখা মেলে ভুটভুটি, নছিমন, করিমন কিংবা পিকআপের। এগুলো দ্রুতগতির এবং তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় মানুষ গরুর গাড়ির বদলে এসব যন্ত্রচালিত বাহনের ওপর নির্ভর করছে। গরুর গাড়ি তৈরি করাও এখন বেশ ব্যয়বহুল। একটি গরুর গাড়ি বানাতে খরচ পড়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। কেবল চাকার দামই ১০ হাজার টাকার মতো। তার ওপর দুটি বলদ গরু কিনতে লাগে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা। প্রতিদিন গরুদের খাবার খরচ, যত্ন আর চিকিৎসার খরচও যোগ হয়। ফলে এই পদ্ধতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না সাধারণ কৃষক।
গরুর গাড়ির দক্ষ কারিগর বা গাড়িয়ালের সংখ্যাও আজ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। আগের মতো আর কেউ গরুর গাড়ি তৈরি করতে চায় না, কিংবা এই পেশায় আসতেও আগ্রহ দেখায় না। ফলে ঐতিহ্যটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর গ্রামীণ জনপদ থেকে।
এক সময় মানুষের জীবনধারার অংশ ছিল এই গরু-মহিষের গাড়ি। চলাচল, চাষাবাদ এবং সামাজিক আয়োজনে এটি ছিল অমূল্য একটি উপকরণ। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এই প্রথাগত বাহনটি এখন শুধুই ইতিহাসের অংশ। রাজশাহীর গ্রামবাংলায় ঐতিহ্যবাহী এই বাহনের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলুপ্ত, যা আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অধ্যায়ের অবসানকেই প্রতিফলিত করে।
Jahan