ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

চরের শিশুরা বই নয়, ধরে লাঙল—কুড়িগ্রামের নদীভাঙা জনপদে বেঁচে থাকার লড়াই

রফিকুল ইসলাম রফিক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ২২:১৪, ২২ জুন ২০২৫

চরের শিশুরা বই নয়, ধরে লাঙল—কুড়িগ্রামের নদীভাঙা জনপদে বেঁচে থাকার লড়াই

ছবি: জনকন্ঠ

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদীবেষ্টিত কুড়িগ্রাম জেলা। এখানে নদী আছে ১৬টি-আছে ব্রহ্মপুত্র, দার্জলা, তিস্তা, দুধকুমার, গঙ্গাধর, জিনজিরামসহ এক ডজনের বেশি খরস্রোতা। নদী যেমন দিয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তেমনি কেড়ে নিয়েছে মানুষের স্বস্তি ও স্বপ্ন। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষ নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকে,প্রতি বছর ভাঙন, বন্যা, জলাবদ্ধতা আর ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে।

কুড়িগ্রামের সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, ধরলা পাড়, রৌমারী, রাজিবপুর, নদাপাড়া, টাপুরচর, এসব এলাকার মানুষ যেন প্রতি মুহূর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়ছেন।

চরের শিশুরা স্কুল চেনে না। তাদের সকাল হয় খেতের ডাকে, সন্ধ্যা হয় ধানের বোঝা মাথায় ফেরার মধ্য দিয়ে। লেখাপড়ার কথা বললে কেউ হাসে, কেউ চুপ করে থাকে। তাদের কাছে স্কুল মানেই দূরের স্বপ্ন।

সাহেবের আলগা চরের মো. সামিউল ইসলাম(১০) বলেন “স্কুলে যাই না। সকালে বাবার সঙ্গে কাজে বের হই, বাদাম গাড়ি, ভুট্টা গাড়ি, ধান কাটতে যাই, পরে গরু চড়াই। খেলার সময় নাই।”

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মমিনার মা বলেন, “মেয়েকে পড়াতে চাই। কিন্তু খাবার না দিলে কিভাবে পড়বে? দুই ভাই-বোনই বাবা রেখে কাজে যায়, আমরা তো কাজ না করলে খেতে পারি না, কাজ করেই খেতে হয়।”

চর রৌমারীর শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, “অনেক সময় নৌকায় যাত্রা করে স্কুলে আসতে হয়। বর্ষায় অনেকে আসে না। খাদ্য সহায়তা দিলে হয়ত আসত।”

কুড়িগ্রামের নদী-ভাঙা মানুষগুলোর একমাত্র চাওয়া, দুই বেলা খাবার আর মাথার ওপর ছাউনি। একটা শিশুর বয়স যখন ৮–১০, তখন সে চরের খেতে লাঙল ধরছে। কেউ বাবার সঙ্গে মাছ ধরছে, কেউ খড় কুড়িয়ে আনছে। স্কুলের বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছায় না অনেকেই। শিশুরা জানে না খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি কিংবা ছুটির দিন বলতে কিছু। তাদের কাছে ছুটি মানে কাজের দিন।

নদীর পাড়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের একটা বড় অংশই বেড়ে ওঠে শিক্ষাবঞ্চিত হয়ে। এদের অনেকে কৈশোরেই শহরে গিয়ে শ্রমিক হয়, কেউ ইটভাটায়, কেউবা রিকশায়। একজন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, “চরের মেয়েরা পঞ্চম শ্রেণির আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ছেলে-মেয়েরা রোগ-জর্জর, অপুষ্টির শিকার।”

কুড়িগ্রামের ডিসি নূসরাত সুলতানা জানান, "সরকার চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে ।"

সাহেবের আলগা অঞ্চলে নির্মাণাধীন ‘ডিসি পার্ক’ সম্পর্কেও ডিসি বলেন, "এটি হবে এলাকার মানুষের বিনোদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির এক নতুন পথ । চরাঞ্চলে স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে সরকারি প্রকল্প চালু আছে।"

প্রকৃতি যেভাবে গড়েছে কুড়িগ্রামকে, মানুষ সেভাবে গড়ে তুলতে পারেনি। নদী এলাকার মানুষরা এখনও আধুনিক উন্নয়ন থেকে দূরে। শিশুরা শৈশব হারিয়ে জীবিকার চাপে বড় হচ্ছে অসময়ে। এই চিত্র পাল্টাতে হলে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগে চরাঞ্চলে স্কুল, খাদ্য সহায়তা ও শিক্ষাবৃত্তি, নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প, শিশুদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক স্থান, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা ।

এই চরাঞ্চলগুলো শুধু ভূগোলের মানচিত্র নয়, বঞ্চনার প্রতিচ্ছবিও। চরের শিশুদের চোখে যেন শিক্ষার আলো না হারিয়ে যায়। এই নদীর পাড়ে গড়ে উঠুক এক নতুন ভোর,আলোকিত, আশাবাদী ও মানবিক।

Mily

×