
ছবিঃ সংগৃহীত
দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কৃষিনির্ভর জীবিকার এই জনপদে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল পঞ্চগড় সুগার মিল। অথচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ‘অস্থায়ীভাবে’ মিলটি বন্ধ ঘোষণা করার পর থেকে থমকে গেছে হাজারো মানুষের জীবিকা। বর্তমানে পরিত্যক্ত মিল প্রাঙ্গণ যেন কেবলই নীরবতা আর জংধরা যন্ত্রপাতির সাক্ষ্য বহন করে।
অতীতের গৌরব, বর্তমানের গ্লানি
১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চগড় সুগার মিল দেশের সর্বশেষ সরকারি চিনিকল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মিলটি ছিল পঞ্চগড়সহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর আখচাষীদের জন্য এক বিশাল আশীর্বাদ। মিলটিতে প্রায় এক হাজার শ্রমিক ও কর্মকর্তা সরাসরি কর্মরত ছিলেন। পরোক্ষভাবে আরও কয়েক হাজার কৃষক, পরিবহনকর্মী ও ব্যবসায়ী মিলকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।
চলমান অবস্থায় মিলটি বছরে প্রায় ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ প্রক্রিয়াজাত করে উৎপাদন করত ৫-৬ হাজার মেট্রিক টন চিনি। তবে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতায় মিলটি ক্রমেই অলাভজনক হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয় কার্যক্রম।
আখচাষে ভাটা, বেকারত্বে বাড়তি চাপ
মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে আখচাষ। এক সময় পঞ্চগড়ের সহস্রাধিক কৃষক মিল ঘিরে আখ চাষে নিয়োজিত থাকলেও বর্তমানে সে সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের নিচে নেমে এসেছে। বাজার না থাকায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে অন্য ফসলে ঝুঁকছেন, যদিও লাভের পরিমাণ সেখানে কম।
মিল-নির্ভর শ্রমজীবী বিশেষ করে ট্রাকচালক, হেলপার, পরিবহনকর্মী, দোকানদার, চায়ের দোকান মালিক তাদের জীবনেও নেমে এসেছে অভাব-অনটনের ছায়া। মিলঘেঁষা জনপদগুলোতে বেড়েছে বেকারত্ব, কমেছে আয়।
চিনিকল চালু হলে সম্ভাবনার দ্বার খুলবে
অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পঞ্চগড় সুগার মিলকে আবারও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ায় আখচাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। মিল চালু হলে স্থানীয় চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি মোলাসেস, বায়োগ্যাস ও ইথানল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হবে।
ভারতের সীমান্তঘেঁষা অবস্থান দেশের বাইরেও রপ্তানির পথ খুলে দিতে পারে।
এতে শুধু পঞ্চগড় নয়, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁওয়ের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে, আয়তেও গতি আসবে।
জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দেন, বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা
বিভিন্ন সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মিলটি চালুর আশ্বাস দিলেও বাস্তব অগ্রগতি নেই বললেই চলে। মিলচত্বর এখন ধ্বংসপ্রায়—জংধরা যন্ত্রপাতি আর জরাজীর্ণ ভবনের সারি। অনেক শ্রমিক পেশা বদল করে অন্যত্র চলে গেছেন।
“চালু হোক চিনিকল, বাঁচুক উত্তরাঞ্চল”
পঞ্চগড়ের সাধারণ মানুষদের প্রত্যাশা—মিলটি চালু হলে এটি হবে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের মূল চালিকাশক্তি। পাশের জেলাগুলোর চাষিরাও এতে উপকৃত হবেন।
পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জানান, চার বছর বন্ধ থাকার পর মিলটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর ছয়টি বন্ধ চিনিকল পঞ্চগড়, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, সেতাবগঞ্জ ও শ্যামপুরে আখ মাড়াই কার্যক্রম পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে মাঠপর্যায়ে এখনও তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
চিনিকল নয়, এটি একটি অঞ্চলের প্রাণভোমরা
আজ শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, পুরো একটি অঞ্চল থমকে আছে একটি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। সেই সিদ্ধান্ত যদি হয় সাহসী ও দূরদর্শী, তবে আবারও বেজে উঠতে পারে পঞ্চগড় সুগার মিলের সাইরেন। ফিরতে পারে হারানো কর্মসংস্থান, চাঙ্গা হতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি।
ইমরান