
ছবি:জনকণ্ঠ
দেশের দূর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোর অন্যতম বরগুনা জেলার এ তালতলী উপজেলা ।প্রতি বছরই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে যুদ্ধ করেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় এ উপজেলার বাসিন্দারা। ঘূর্ণিঝড়সহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এ দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন।
এ উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর কূল ঘেঁষে ২০ কিলোমিটারজুড়ে ছইলা ও কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করেছে বন বিভাগ। যেটাকে বলা হয় সবুজ দেয়াল। তবে এটি শুধু নামেই বনাঞ্চল। দেখলে মনে হবে যেন ব্যক্তি মালিকানাধীন বনভূমি। বনের গাছ কেটে উজাড় করে বনের জমি দখল করে প্রায় অর্ধশত মৎস্য ঘের নির্মাণ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এভাবে বনের জমি দখল হয় ও বনভূমি কমছে, অন্যদিকে দিন দিন উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চাল। ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী ও পাখির আবাসস্থল। এতে হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য এবং ঝুঁকি বাড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগের।
বন বিভাগ বলছে, দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মামলা-হামলার হুমকি দিচ্ছেন। তবে পর্যায়ক্রমে দখলদারদের বিরুদ্ধে বনবিভাগের পক্ষ থেকে নোটিশ করা হচ্ছে। তারা নোটিশের সদুত্তর দিতে না পারলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রভাবশালী ও বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই বনের গাছ কাটা হচ্ছে। এতে লেনদেন হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। গাছ কেটে জমি দখল এবং পরে মৎস্য ঘের নির্মাণ করা হচ্ছে।
বন আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত কিংবা সরকারি জমিতে কোনো গাছ কাটার আগে স্থানীয় বন বিভাগের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। ২০২৪ সালের আইনে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ব্যতীত গাছ কাটাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। শুধু জরুরী অবস্থা বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য গাছ কাটার অনুমতি দেয়া হয়। নতুন আইনে অবৈধভাবে গাছ কাটার জন্য জরিমানা ও শাস্তির বিধান বাড়ানো হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার শারিকখালী ইউনিয়নের আঙ্গারপাড়া গ্রামে আন্ধারমানিক নদীর তীর থেকে শুরু করে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ পর্যন্ত ১৫০ মিটার বনাঞ্চল উজাড় করে খনন যন্ত্র (এস্কেভেটর) দিয়ে মৎস্য ঘের নির্মাণ করছেন স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল খালেক মিয়া। সেখান থেকে একটু সামনে এগিয়ে চাউলাপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় নদীতীরবর্তী বনের ছইলা, কেওড়া ও নানা প্রজাতির কয়েক হাজার চারা গাছ কেটে খনন যন্ত্র (এস্কেভেটর) দিয়ে প্রায় দুই একর জমি খনন করে মৎস্য ঘের নির্মাণ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী বাসিন্দা বাবুল মৃধা ও জাকির মৃধা। এছাড়াও ঘেরের মাঝে মাচান দিয়ে নির্মান করছে ছোট্ট পাহারা দেয়ার ঘর ও পানি ওঠানো-নামানোর জন্য ইট দিয়ে স্থায়ী কালভার্ট। একইভাবে বড়বগী ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া খেয়াঘাট থেকে শারিকখালী ইউনিয়নের চাউলাপাড়া গ্রাম পর্যন্ত আন্ধারমানিক নদীর তীরে জমি দখল ও বনাঞ্চল উজাড় করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মৎস্য ঘের নির্মাণের মহোৎসব চলছে। এখানে একে একে প্রায় অর্ধশত মৎস্য ঘের নির্মাণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দখলদার বাবুল মৃধা, জাকির মৃধা, আমাদের বাড়ির সম্মুখভাগ (মুখসা) এই জমি আমরা বন্ধবস্তÍ নিয়েছি। এখানে চিংড়ি মাছ চাষ করার জন্য ঘের নির্মণ করেছি। বনের গাছ কেটে ঘের নির্মণ করার বিষয় জানতে চাইলে বলেন, এখানে বনবিভাগের লোকজন আসছিলো তারা দেখে গেছেন। দখলদার আব্দুল খালেক মিয়া বলেন, আমার রেকর্ডি জমিতে মৎস্য ঘের নির্মণ করতেছি। বনের গাছ কেটে ঘের নির্মণ করার বিষয় জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। দখলদার আকাব্বার বলেন, ঘেরের ভিতরে আমাদের কিছু রেকর্ডি জমি ও সরকারি জমি মিলিয়ে মৎস্য ঘের নির্মাণ করেছি।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা'র) বরগুনা জেলা শাখার সদস্য সচিব মুশফিক আরিফ বলেন, সর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে, এ কারণেই প্রতিনিয়ত বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সঠিকভাবে কাজ করলে এ ধরনের অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমে যেত। আমাদের উপকূল এবং বনভূমি রক্ষায় সরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যেগে গ্রহন করতে হবে। কঠোর আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই বনের গাছ কাটা হচ্ছে, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন তালতলী রেঞ্জের কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, বনবিভাগের পক্ষ থেকে দখলদারদের বিরূদ্ধে ৬ টি মামলা করা হয়েছে। এছাড়াও ২৫ জন দখলদারকে নোটিশ করা হয়েছে।
তালতলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমা বলেন, চাউলাপাড়া গ্রামে বনবিভাগের গাছ কেটে ঘের নির্মাণের ঘটনায় বনবিভাগের পক্ষ থেকে ইতি মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন যারা আইন অমান্য করে সরকারি জমি দখল ও বনের গাছ কেটে ঘের নির্মাণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আঁখি