ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জিআই স্বীকৃতি পেলো সুন্দরবনের মধু: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২৫ মে ২০২৫

জিআই স্বীকৃতি পেলো সুন্দরবনের মধু: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

দৈনিক জনকণ্ঠ

প্রতি বছর এপ্রিল ও মে মাসে উপকূলীয় অঞ্চলের চার হাজারেরও বেশি পেশাদার মৌয়াল রওনা হন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের দিকে। তাঁদের মূল লক্ষ্য বনভিত্তিক খাঁটি মধু সংগ্রহ। বছরের অন্যান্য সময়ে জীবিকার টানাপোড়েনে থাকা এসব মৌয়ালের কাছে এই দুই মাস যেন স্বপ্নপূরণের মৌসুম।

সুন্দরবনের মধু শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের আয়ের উৎস নয়, বরং এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও স্বতন্ত্র পণ্য। এর স্বাদ, ঘ্রাণ ও বিশুদ্ধতা অতুলনীয়, যা দেশের বাজারে যেমন জনপ্রিয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও যার চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌচাষিরা ফুলভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের মধু সংগ্রহ করলেও প্রাকৃতিক উৎপত্তি ও মানের দিক থেকে সুন্দরবনের মধুর কোনো তুলনা নেই।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে এই মধু ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি অর্জন করে, যা দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। যদিও এর আগেই ২০২৪ সালে ভারত সুন্দরবনের মধুকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করায় বাংলাদেশে মধু ব্যবসায়ী, গবেষক ও মৌয়ালদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশও এই স্বীকৃতি অর্জনে সফল হয়।

এই অর্জন যেমন গর্বের, তেমনি এর সঙ্গে জড়িত কিছু গভীর উদ্বেগও রয়েছে। মৌসুম শুরুর আগেই কিছু অসাধু জেলে ও বাওয়ালি অপরিপক্ব মধুর চাক কেটে নিচ্ছেন, যা মধুর গুণগত মান নষ্ট করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক প্রজনন চক্রও বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে, কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে চিনি জ্বালিয়ে মধু তৈরি করছেন এবং বাক্সে মৌমাছি রেখে বনভিত্তিক মধু বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এতে প্রকৃত মৌয়ালরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

২০২৪ সালে শুধু সাতক্ষীরা রেঞ্জেই ৩৬৪টি পাশের মাধ্যমে ১,২৩৫ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু ও ৩৭০ দশমিক ৬৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহ হয়, যা থেকে সরকার প্রায় ২৮ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করে। ২০২৫ সালের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়িয়ে ধরা হয়েছে মধুর ক্ষেত্রে ১,৫০০ কুইন্টাল এবং মোমের ক্ষেত্রে ৪০০ কুইন্টাল।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বনাঞ্চলে ফুল ফোটার হার কমে যাওয়ায় মধু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। মধু উৎপাদনের সঙ্গে ফুলের সরাসরি সম্পর্ক থাকায় এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আশার কথা হলো, বন বিভাগ ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ফুলজাতীয় গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে মধু উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রাকৃতিক মধু নিউজিল্যান্ডের ‘ভানুকা’ মধু, যার কেজিপ্রতি দাম ৫০-৬০ হাজার টাকা। সুন্দরবনের মধুও যদি উপযুক্তভাবে প্রক্রিয়াজাত ও মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যায়, তবে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে একই মর্যাদা লাভ করতে পারে।

সরকারিভাবে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন, মান নির্ধারণ ও রপ্তানির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে এ খাত হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় উৎস। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান, যা জাতীয় অর্থনীতিকে আরও চাঙা করতে সহায়তা করবে।

সুন্দরবনের মধু শুধু এক বোতল সুস্বাদু তরল নয়, এটি আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, জীবিকাভিত্তিক সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আত্মনির্ভরতার প্রতীক। এই সম্পদ রক্ষা করা শুধু দায়িত্ব নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মূল্যবান সঞ্চয়ও বটে।

হ্যাপী

×