
বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন সুন্দরবন। বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভ বনভূমি, জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই বন প্রত্যেক বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে। কলাগাছিয়া, করমজল, কটকা, কচিখালী, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চরসহ বেশ কিছু পর্যটন স্পট এখন জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। তবে পর্যটকদের আগমনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এক নতুন ধরনের হুমকি—বিষাক্ত প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্যের আগ্রাসন।
পর্যটকদের অনেকেই বেড়াতে এসে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ না করে ফেলে যাচ্ছেন চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, প্লাস্টিক বোতল, খাবারের মোড়ক ও পলিথিন ব্যাগ। এইসব অপচনশীল বর্জ্য সুন্দরবনের পবিত্র ভূমিকে করে তুলছে দৃষ্টিকটু ও বিষাক্ত। দৃশ্যদূষণ তো বটেই, এইসব আবর্জনা ধীরে ধীরে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় এখন আর আগের মতো স্নিগ্ধতা বা নির্মলতা অনুভব করা যায় না। অনেক স্থানে আবর্জনার স্তূপ দেখা যায়। নদীর পাড়, ঝোপঝাড় কিংবা পায়ে চলা পথের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য। করমজল ও কলাগাছিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু পরিবেশের ক্ষতি করছে না, বন্যপ্রাণীর জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
শ্যামনগরের অভিজ্ঞ ট্যুর অপারেটর মাসুমবিল্লাহ জানান, “প্রতিটি সফরের আগে আমরা পর্যটকদের নির্দেশনা দিই, যেন তারা প্লাস্টিক না ফেলেন। আবর্জনা ফেলার জন্য জাহাজে বা বোটে ব্যাগও সরবরাহ করি। কিন্তু বেশিরভাগই সেসব নির্দেশনা মানেন না। ফিরে আসার পথে দেখা যায়, যেখানে তারা অবস্থান করেছেন, সেখানেই পড়ে থাকে নানা ধরনের আবর্জনা।”
স্থানীয় বনগাইড রফিক সানা বলেন, “পর্যটকদের সঙ্গে যখন বনের গভীরে যাই, তখন তাদের বলি যেন কোনো শব্দ না করে এবং কিছু না ফেলে। কিন্তু অনেকেই গোপনে ফেলে দেন। আমরা পরে সেগুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করি, কিন্তু সব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। মাঝে মাঝে হরিণ বা বানরকে দেখা যায় প্লাস্টিক মুখে দিয়ে চিবোতে—সেটা দেখলে খুব খারাপ লাগে।”
এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা বলছেন, এই “স্মৃতিচিহ্ন” আসলে একেকটি নীরব ঘাতক, যা মাটি, পানি ও প্রাণীকুলের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্য মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, নদীতে জমে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, এমনকি পশুপাখি ভুল করে সেগুলো খেয়ে ফেলছে, যা তাদের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ পর্যটকই সুন্দরবনের পরিবেশগত সংবেদনশীলতা সম্পর্কে অবগত নন। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে, আবার কেউ কেউ অসচেতনভাবে বনের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।
পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বন বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, সুন্দরবনের প্রবেশপথ, জাহাজ, বোট ও পর্যটন স্পটগুলোতে তথ্যচিত্র, অডিও-ভিজ্যুয়াল বার্তা, সাইনবোর্ড ও লিফলেটের মাধ্যমে পর্যটকদের সচেতন করতে হবে। পর্যটনের শুরুতেই নির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে হবে, যাতে কেউ কোনো ধরনের বর্জ্য না ফেলেন।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং কেউ এই নিয়ম অমান্য করলে জরিমানার বিধান চালু করতে হবে। পর্যটকরা প্লাস্টিক বোতল বা মোড়ক নিয়ে প্রবেশ করলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে আদায় করা যেতে পারে এবং নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য জমা দিলে তা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা উচিত।
পর্যটন স্পটগুলোতে ঢাকনাযুক্ত পর্যাপ্ত ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে এবং সেখান থেকে নিয়মিতভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করে পরিবেশসম্মত উপায়ে লোকালয়ে এনে নিষ্কাশন বা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটর ও গাইডদের পরিবেশ সচেতনতার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা শুধু নির্দেশনা না দিয়ে, পর্যটকদের পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। পরিবেশবান্ধব পর্যটন কার্যক্রম উৎসাহিত করতে 'প্লাস্টিকমুক্ত’ নীতিমালার আওতায় থাকা অপারেটরদের পুরস্কৃত ও স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন জানান, “আগামী পর্যটন মৌসুম শুরুর আগে ট্যুর অপারেটর ও গাইডদের নিয়ে আলোচনা করা হবে। তারা যেন পর্যটকদের সচেতন করেন, সে বিষয়ে কার্যকর নির্দেশনা দেওয়া হবে। পাশাপাশি নিয়ম না মানলে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হবে।”
সুন্দরবনের মতো বিশ্বঐতিহ্যের স্থান রক্ষার দায় শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার। সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে একে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে, আগামী প্রজন্ম হয়তো এই অসাধারণ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য শুধু বইয়ের পাতায় দেখতে পাবে।
সজিব