ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

‘যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরলে তোমাকেই বিয়ে করবো’: সেই স্ত্রী ফরিদা বেগম পেলেন রত্নগর্ভা মা-এর সম্মাননা

তাহমিন হক, স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১৩ মে ২০২৫; আপডেট: ২৩:১৫, ১৩ মে ২০২৫

‘যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরলে তোমাকেই বিয়ে করবো’: সেই স্ত্রী ফরিদা বেগম পেলেন রত্নগর্ভা মা-এর সম্মাননা

বিয়ের জন্য ছেলে মেয়ের দেখা শোনা ও পছন্দ হলো। এবার বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করবেন দুই পরিবার। এমন সময় যুদ্ধের দামামা বেঁজে উঠলো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ। টগবগে যুবক সহিদ উদ্দিন। ঘরে আর বসে থাকতে পারলেন না। ঝাপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। তাই তিনি যুদ্ধে যাবার সময় হবু স্ত্রী ফরিদা বেগমকে বলে গেলেন যুদ্ধ থেকে যদি বেঁচে আসি। তাহলে তোমাকেই বিয়ে করবো। তারপর দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের সময় নিজ পরিবার পরিজনের সাথে নিরাপদে আশ্রয় নিলেন ফরিদা বেগম। অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন কবে যুদ্ধ শেষ হবে, বীরযোদ্ধা হিসাবে তার হবু স্বামী ফিরে এসে তাকে স্ত্রী হিসাবে ঘরে তুলে নিবেন। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। বীরমুক্তিযোদ্ধা হয়ে সহিদ উদ্দিন বেঁচেই ফিরে এলেন। তবে আহত ছিলেন। এরপর দুই পরিবার দিনক্ষণ ঠিক করলেন।  ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ফরিদা বেগমকে বিয়ে করে ঘরে তুললেন সেই যোদ্ধা। 

এই দম্পতি তাদের  ৫টি সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ফরিদা বেগম এবারে বিশ্ব মা দিবসে জাতীয় পর্যায়ে রত্নাগর্ভা মায়ের সম্মাননা পেয়েছেন। বিগত দিনের কথা গুলো ঠিক এভাবেই স্মরণ করে বলছিলেন এই রত্নাগর্ভা মা।

নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের কয়াগোলাহাট দক্ষিণপাড়ার বীরমুক্তিযোদ্ধা সহিদ উদ্দিনের সহধর্মিনী হিসাবে ফরিদা বেগম আজ গর্ভবোধ করেন। স্বামী সৈয়দপুর পৌরসভার একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন তিনি।

গত রবিবার  (১২ মে) বিশ্ব মা দিবসে আজাদ প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত  এক অনুষ্ঠানে রত্নগর্ভা মা সম্মাননা ২০২৩-২০২৪ প্রদান করা হয়। সেখানে তিনি গিয়ে অনুষ্ঠানের  প্রধান অতিথি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আ, ন, ম এহসানুল হক মিলন সহ অন্যান্য অতিথির হাত থেকে সম্মাননা  পেয়েছেন।

জানা যায় অনুষ্ঠানে এবারে সাধারণ ও বিশেষ দুই ক্যাটাগরিতে রত্নগর্ভা ৩৫জন মাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে সাধারণ ক্যাটারিতে সম্মাননা পেয়েছেন সৈয়দপুরের মোছা. ফরিদা বেগম।

তার  পাঁচ সন্তানের  মধ্যে তিনজন ছেলে ও দুইজন মেয়ে ।  স্বামী বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. সহিদ উদ্দিন সৈয়দপুর পৌরসভার একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। অস্বচ্ছল পরিবারের একজন আদর্শ মা ফরিদা বেগম অল্প শিক্ষিত হয়েও  পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে তাঁর পাঁচজন ছেলেমেয়েকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বর্তমানে তারা সবাই দেশে ও বিদেশে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। রত্নগর্ভা ফরিদা বেগমের প্রথম সন্তান মো. ফারুক আহমেদ। তিনি রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিকম (অনার্স) এমকম (হিসাব বিজ্ঞান) ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি সৈয়দপুর সানফাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। দ্বিতীয় সন্তান মো. হুমায়ুন কবীর। সিলেট শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (সমাজ বিজ্ঞান) ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে কর্মরত। অর্জন করেছেন পুলিশের পিপিএম এ্যাওয়াড। তৃতীয় সন্তান  সামসুন নাহার। তিনি নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে বিএসএস,এমএসএস পাস করেন। বর্তমানে নীলফামারী সদর উপজেলায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।চতুর্থ সন্তান মোছা. নাজমা নাহার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (অনার্স) এলএলএম ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে উপসচিব পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আর পঞ্চম সন্তান ফয়সাল আহমেদ মাসুম। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেশন ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ইন ইনফরমেশন টেকনোলজি ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির এসেনশিওর ফেডারেল সার্ভিসেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রত্নাগর্ভা এই মা আজ এই সম্মাননা পেয়ে সেটি বুকে ধারন করে বললেন সব আল্লাহর ইচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা  স্বামীর অনুপ্রেরণায় অল্প শিক্ষিত হয়ে আমি  ৫ সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।

মুমু

×