
ছবি : জনকণ্ঠ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক কলস বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার দেখা দিয়েছে। অবৈধ সেচ পাম্পের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সকল নলকূপ অচল হয়ে গেছে। ফলে তপ্ত বৈশাখের এই প্রচণ্ড দাবদাহে চারপাশে হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে।
শনিবার সরেজমিনে সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় একটি এনজিওর পানির গাড়ি আসার খবরে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ‘সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র গাড়ি দেখে মসজিদের মাইকে পানির গাড়ি আসার ঘোষণা দেওয়া হয়। মুহূর্তেই এক কলস খাবার পানির জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন স্থানীয়রা। পানি শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কলস নিয়ে গাড়ি ঘিরে ধরেন তারা। আগে না নিলে পানি পাবে না—এই ভয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বৃহৎ এই চরাঞ্চলে ইরি-বোরো চাষে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য অবৈধ সেচ পাম্প বসানো হয়েছে। ফলে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে সুবর্ণচরে ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। তবে এবার এ সংকট অন্য বছরের তুলনায় আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগেও সুবর্ণচরে এমন চিত্র ছিল না। তখন এলাকায় বোরো চাষ হতো কম, বেশিরভাগ মানুষ রবিশস্য উৎপাদন করত। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ছিল তুলনামূলকভাবে কম। কৃষিকাজের জন্য ২৪৫টি সেচ পাম্পের অনুমতি থাকলেও অপরিকল্পিতভাবে বসানো হয়েছে আরও তিন হাজারের বেশি সেচ পাম্প। এতে দিনদিন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বেড়েছে।
পানি সংগ্রহ করতে আসা সুবর্ণচরের পূর্ব চরবাটা গ্রামের গৃহিণী রাবেয়া বেগম (৪৫) জানান, “বাড়িতে নলকূপ আছে, কিন্তু পানি উঠছে না। আশপাশের বাড়িতেও একই অবস্থা। তাই সুপেয় পানির জন্য এনজিওর গাড়ির ওপর ভরসা করতে হয় সবাইকে। খাবার পানির পাশাপাশি অজু, গোসল, ধোয়া-মোছাসহ বাথরুম ব্যবহারেও চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছি আমরা।”
এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি নিয়ে ফিরছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন (৩৭)। তিনি বলেন, “রোজার ঈদের পর স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাড়িতে কিছুদিন পানি সরবরাহ করা হয়। এরপর সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটি একটি গাড়িতে পানি দিচ্ছে। এতে কোনো রকম চলে। তবে গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হলে আমাদের অনেক উপকার হতো।”
সুবর্ণচরের স্থানীয় বাজারের বাসিন্দা জয়নাল মিয়া (৫৮) বলেন, “খাওয়ার পানির কষ্ট তো আছেই, এখন পুকুরগুলোও সব শুকিয়ে যাচ্ছে। গোসল আর ধোয়া-মোছার পানির সংকটও বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” এদিকে সরকারের সংস্থাগুলোকে আরও বেশি নজর দেওয়ার দাবি জানান এই বৃদ্ধ।
সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম বলেন, “গত ২১ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে জনস্বাস্থ্যের একটি গাড়ি সংগ্রহ করে তা দিয়েই জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা শহরের ১০-১২টি পয়েন্টে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা গাড়ির কাছে আসেন পানি নিতে। অনেকে পানি না পেয়ে খালি হাতে ফেরত যান, যা খুবই কষ্টের।”
তিনি আরও বলেন, “একটি গাড়ি দিয়ে প্রতিদিন দুই দফায় ৮ হাজার লিটার পানি বিতরণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নানাভাবে পানি সংকট সমাধানে কাজ করছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের এই উপজেলায় অসংখ্য পরিবার এখনো এ সুবিধার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমরা বেসরকারিভাবে ছোট পরিসরে হলেও সংকট নিরসনে চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এটি বাড়ানো হবে।”
সুবর্ণচরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চন্দ্রকলির নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, “কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণেই সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত বৃহৎ এই এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন আছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না।”
পূর্ব চরবাটা, হাজীপুর ও চরমজিদ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, “আমার ব্লকে এবার ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষ হয়েছে। এখানে ২৫টি শ্যালো, দুটি গভীর নলকূপ এবং বিএডিসির একটি সোলার পাম্প রয়েছে, যেখানে অতিরিক্ত চাপে এখন পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।”
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ জানান, “২০২২ সালের পর এবার পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নিচে নেমেছে। শুধুমাত্র কৃষির কারণে এমন পরিস্থিতি কিনা, তা যাচাই করা হচ্ছে। এ নিয়ে আজ রোববার উপজেলায় উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।”
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সুবর্ণচরের পানির সংকটাপন্ন অবস্থা দেখতে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন খান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলমসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা নোয়াখালী আসছেন। তারা বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে আজ রোববার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে “পানি সংকট নিরসনে করণীয়” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় অংশ নেবেন।
সা/ই