ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

শারদীয় উৎসব আসন্ন 

বাঙালি ঐতিহ্যের বাদ্য ঢোল, সম্প্রীতির বন্ধন আদিকালের

সমুদ্র হক 

প্রকাশিত: ০০:০৮, ৮ অক্টোবর ২০২৩

বাঙালি ঐতিহ্যের বাদ্য ঢোল, সম্প্রীতির বন্ধন আদিকালের

বগুড়ার চেলোপাড়ায় ঢোল-খোল মেরামত করছেন ঢুলি

ঢাকঢোল। বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুকাল আগে। প্রবাদে ঢাকঢোল শব্দটি ব্যবহার হয় প্রচারের অতি আনন্দের প্রকাশে। দূর অতীতে নতুন ধান ঘরে ওঠার উৎসবে নদীতে বজরা নৌকায় ঢাকঢোল বাজিয়ে নাচ গান করা হতো। নিকট অতীতের খেয়াঘাটের কাছে ছিল ঢাকিদের (যারা ঢোল বাজায়) বাস। বাইচের নৌকায়  ঢোল ও কাঁসরের বাদ্য থাকবেই। তা না হলে  বৈঠা দ্রুত চলবেই না। বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্র ঢোল। সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে ঢোলের বাদ্য না হলেই নয়। গ্রামীণ মেলা, পূজা পার্বণ, শোভাযাত্রা, লোকগান, বাউল, ভাটিয়ালী, জারি সারি বিয়ের গান, লাঠি খেলা ঢাকঢোল ছাড়া হয় না। সংগীত শাস্ত্রে ঢোলকে আনন্দ শ্রেণির বাদ্য যন্ত্র মনে করা হয়।
শারদীয় উৎসবের (দুর্গোৎসব) সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ ঢাকের বাদ্য। সমুখের এই উৎসব। দুর্গোৎসবের ঢাকের বাদ্যি কোথাও এখনই বেজে উঠেছে। এই সময়ে  ছোটাছুটি শুরু হয়েছে ঢাকিদের। ঢাক ঢোলের (ঢুলি) দোকানগুলোতে ঢোল খোল ঠিকঠাক করার কাজ চলছে। ঢুলিদের একদ- ফুরসত নেই। বগুড়ার চেলোপাড়া এলাকার ধনঞ্জয় বললেন, তাড়াতাড়ি ঢোল ঠিক করে দিতে হবে। ঢাকিরা তাড়া দিচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে ঢাকিরা ঢোল ও খোল বাজাবে। ঢোলকে রং করে, রঙ্গিন কাপড়ে মুড়িয়ে সাজিয়ে তুলেবে। বছরের বড় এই উৎসবে মনের মাধুরি মিশিয়ে ঢাক বাজাবার অপেক্ষায় থাকে ঢাকিরা। দুর্গোৎসবে ঢাক বাজাবার আলাদা একটা ঢং আছে- বললেন বগুড়ার গাবতলির ঢাকি নিরঞ্জন।

ঢাক বাজানো একটা শৈলী। ঢাক খোলের আলাদা তাল ও লয় আছে। উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণের কণ্ঠে ১৯৭১ সালের সাড়া জাগানো গান ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ কালের সাক্ষী হয়ে আছে। আদিকালে ঢোল বাজানো হতো দুই হাতের তালু দিয়ে। সঙ্গে আঙুলের ব্যবহার আলাদা ছন্দ এনে দিত। এর পর কাঠি দিয়ে বাজানো শুরু হয়। ঢাকের কাঠি বেত ও কঞ্চিতে তৈরি। পূজা ম-পগুলোতে পূজা অর্চনায় ঢাকের বাদ্যের তালে ধূপের ধোঁয়ায় দেওয়া হয় আরতি। বগুড়ার দুর্গাহাটার ঢাকি বিমল চন্দ্র বলেন, ভর বছর দুর্গোপূজার ডাকের অপেক্ষায় থাকেন। বংশ পরম্পরায় তিনি ঢাকি। পূজা অর্চনায় কখন ঢাকের কোন বাদ্য বাজাতে হবে তা শিখেছেন পূর্বসূরিদের কাছ থেকে।    
ঢোলের বাদনেরও সুর তাল আছে। ত্রিতাল, কারহারবা, দাদরার লয়ে ঢোল বাজানো হয় বেশি। ঢাকি শরীরের ছন্দময় দুলুনিতে ঢোল বাজায়। মনে হবে যেন ঢাকি নৃত্য। কত কৌশল ও কসরত করে যে ঢোল বাজানো হয়- বাহুতে ফিতা দিয়ে ঝুলিয়ে ঢোল শরীরের বাম পাশে রেখে দুই হাতে কাঠি দিয়ে বাজানো হয় বেশি। এ ছাড়াও ঢোল মাটিতে রেখে, তিন ঢোল পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে, একজনের ঢোলে আরেক জন কাঠি দিয়ে বাজায়। ঢোলের সঙ্গে খোল ও ঢপকি ঢোল থাকে।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাকদুদ তাকদুম ঢাকের সুর। প্রতিটি স্থানের পূজা কমিটি ঢাকিদের আগে থেকেই চুক্তি করে  রেখেছে। বগুড়ার পূজা কমিটির কয়েক সদস্য জানালেন, প্রতিটি ম-পে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় সার্ভিলেন্স থাকবে। কারিগররা প্রতিমা বানানোর কাজ শেষ পর্যায়ে এনেছে। ম-পে সময়মতো প্রতিমা স্থাপিত হবে। তার আগে ঢাকিদের বায়নার কাজ শেষ করতে হচ্ছে। দুর্গোৎসবের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ ঢাকের বাদ্য।
বাংলাদেশে ঢোল যে প্রাচীনতম বাদ্য এই বিষেয়ে দ্বিমত নেই। শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন, বাংলার সংস্কৃতিতে ঢোল শব্দের উৎপত্তি ফারসী ‘দহ’ শব্দ থেকে। অনেকে মনে করেন ভারতীয় উপমহাদশে ঢোলের উদ্ভাবন করেন ওস্তাদ আমীর খসরু। বাংলাদেশে অন্তজ শ্রেণির সম্প্রদায় ঢুলি নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে তিনশ’ বছরের পুরনো ঢোলবেচাকেনার হাট আছে। এই ঢোলকে ঘিরেই দেশে দেশে বানানো হয়েছে ড্রাম সেট, বেসটম, স্লায়ারসহ বিভিন্ন কিছু। আদি ঢোল দেখেই রক ও জ্যাজ মিউজিকে বিশেষ ধরনের নানা আকৃতির ড্রাম সেট বানানো হয়েছে। 
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মালদ্বীপ ভুটান ও নেপালে এবং আফ্রিকা মহাদেশে ঢোলের ব্যবহার প্রতিদিনের। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিতে ঢোলের ব্যবহার আছে। লাতিন আমেরিকার নাচে গানে হাজার বছরের ঐতিহ্য এই ঢোল। বিশ্বখ্যাত সাম্বা নাচ ঢোল ছাড়া হবেই না। ক্যারিবিয়ান, লাম্বাডা নাচে ঢোল অপরিহার্য।

×