ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

ঢাকা-৩

নৌকার পালে হাওয়া ॥ ব্যালট বিপ্লবের আশা বিএনপির

শরীফুল ইসলাম/আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:১৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

নৌকার পালে হাওয়া ॥ ব্যালট বিপ্লবের আশা বিএনপির

রাজধানী ঢাকার  অতি  সন্নিকটে  হওয়ায় জাতীয় সংসদের ১৭৬ (ঢাকা-৩) আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

রাজধানী ঢাকার  অতি  সন্নিকটে  হওয়ায় জাতীয় সংসদের ১৭৬ (ঢাকা-৩) আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে বড় রাজনৈতিক দলগুলো আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে এলাকাবাসী মনে করছেন। তাই তো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এলাকায় গণসংযোগ জোরদার করেছেন। ভোটারসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেও জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কোন দল বা কোন প্রার্থী নির্বাচিত হলে এলাকাবাসী বেশি উপকৃত  হবেন এ নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ। 
সরেজমিন জাতীয় সংসদের ১৭৬ (ঢাকা-৩) আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিতে কোনো বিরোধ বা কোন্দল নেই। এর কারণ, এ এলাকায় দুই দলেরই একক সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছেন। আর তাদের পক্ষে রয়েছেন নিজ নিজ দলের সর্বস্তরের নেতকর্মীরা। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিয়মিত এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নসরুল হামিদের পক্ষে তার কর্মী-সমর্থকরা এলাকায় ঐক্যবদ্ধভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পালনের পাশাপাশি তার ছবি দলীয় নির্বাচনী প্রতীক নৌকা সংবলিত ব্যানার ও  পোস্টার সাঁটিয়ে সমগ্র এলাকায় নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই নৌকার পালে হাওয়া লেগেছে। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায়ের পক্ষে তেমন প্রচারের চিত্র চোখে না পড়লেও দলটির স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এ এলাকায় ব্যালট বিপ্লব হবে। এ ছাড়া একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচন করা  গণফোরামের সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টুর পক্ষে কিছু লোক কাজ শুরু করলেও চোখে পড়ার মতো তেমন প্রচারের চিত্র লক্ষ্য করা যায়নি। অন্যান্য দলের কোনো প্রার্থীর পক্ষেও কার্যত প্রচার শুরু হয়নি। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছেন, শীঘ্রই অন্য প্রার্থীরাও নির্বাচনী প্রচার শুরু করবেন। 
রাজধানীর সীমানাঘেঁষা ঢাকা-৩ আসনটি ঢাকা জেলার  কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিনজিরা, আগানগর,  তেঘরিয়া,   কোন্ডা ও শুভাঢ্যা এই ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই সংসদীয় আসনে ভোটার ৩ লাখ ১১ হাজার ৬৪৭ জন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা-৩ আসন থেকে প্রথমবারের মতো ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মফিজুল ইসলাম খান কামাল। এর পর ১৯৭৯ সালে বিএনপির নিজাম উদ্দীন খান, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের  মোস্তাফা মহসিন মন্টু ও ১৯৮৮    সালে জাতীয় পার্টির সাইফুর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে পর পর ৩ বার বিএনপির আমানউল্লাহ আমান নির্বাচিত হন। তার পর ৩ বার ২০০৮, ১০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নসরুল হামিদ নির্বাচিত হন। 
সরেজমিন ঢাকা-৩ সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ এলাকায় দলীয় বিকল্প কোনো প্রার্থী না থাকায় সর্বস্তরের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। নসরুল হামিদ নিয়মিত এলাকায় গিয়ে মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছেন, কুশল বিনিময় করছেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা জানিয়েছেন, নসরুল হামিদ পর পর ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি এলাকার মানুষের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করেন এবং সুখে-দুঃখে এলাকাবাসীর কাছে থাকেন। এলাকার  ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য হিসেবে সামাজিকভাবেও তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এ কারণে তাঁর বিপক্ষে আওয়ামী লীগ  থেকে আর কেউ প্রার্থী হচ্ছেন না। আর এলাকার দলীয় সাধারণ  নেতাকর্মীরাও মনে করছেন নসরুল হামিদই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর  পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে কাজ করে ভোট দিয়ে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলার চেষ্টা করবেন।

ঢাকা-৩ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থানের কথা জানালেও নিজেদের নাম প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। আপাতত নির্বাচন নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ রয়েছে বলে তারা জানান। নাম প্রকাশ করা হবে না বলে আশ্বাস দেওয়ার পর তারা মুখ খোলেন। তারা জানান, আপাতত বিএনপি নেতাকর্মীরা নীরবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজপথের আন্দোলনে শরিক হচ্ছে। তবে মামলা-নির্যাতনের ভয়ে তারা এলাকায় প্রকাশ্যে দলীয় তেমন বেশি কর্মকা-ে লিপ্ত না হলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ সবকিছুই করছেন।

এ এলাকায় বিএনপির একক প্রার্থী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পক্ষে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন উল্লেখ করে তারা জানান, কোনো কারণে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নির্বাচন করতে না পারলে তার পুত্রবধূ ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরীর মেয়ে নিপুন  রায় চৌধুরী নির্বাচন করবেন। নিপুন রায় চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তবে গয়েশ্বর রায় ও তাঁর পুত্রবধূ নিপুন রায় নির্বাচন করতে না পারলে তাঁর মেয়ে অপর্ণা রায় দলের পক্ষে নির্বাচন করতে পারেন বলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান। এ ছাড়া  গণফোরামের সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু, জাতীয় পার্টি থেকে মনির সরকার, ইসলামি আন্দোলনের সুলতান আহমেদসহ আরও কজন নির্বাচন করবেন বলে এলাকাবাসী জানান।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের ফল কি হয় তা দেখার বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে ঢাকা-৩ আসনের ভোটারদের। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, আগের ৬টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৩ বার করে নির্বাচিত হয়েছে। বর্তমান সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ ২০০১ সালে এই আসনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিএনপির প্রার্থী আমান উল্লাহ আমানের কাছে প্রায় ৭০ হাজার  ভোটে পরাজিত হন। তবে আসনটি পুনর্বিন্যাস হওয়ার পর ২০০৮ সালে আমানউল্লাহ আমান ঢাকা-২ আসন থেকে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে প্রায় ৪২ হাজার  ভোটে পরাজিত করে প্রথমবরের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নসরুল হামিদ। এর পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও নসরুল হামিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার চতুর্থবারের  মতো সংসদ সদস্য হতে চান নসরুল হামিদ।
বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি পর্যায়ক্রমে যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কখনো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি।  ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেরানীগঞ্জ উপজেলাকে ভেঙে ২টি সংসদীয় আসন করা হলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা-৩ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পান। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থী নসরুল হামিদের কাছে হেরে যান। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তবে ২০১৮ সালেবিএনপি নির্বাচনে যায়। কিন্তু ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আওয়ামী লীগের নসরুল হামিদের কাছে পরাজিত হন। আগের ৬ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ এলাকা থেকে যে দল নির্বাচিত হয়েছে সে দলই সরকার গঠন করেছে। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৩ আসন থেকে কোনো দল নির্বাচিত হয় সেদিকে তাকিয়ে আছে স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষ। 
সরেজমিন ঢাকা-৩ সংসদীয় এলাকা ঘুরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়ে কথা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে। জিঞ্জিরা ফেরিঘাটের একটি ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ মালিক জাকির হোসেন জানান, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে দু’জন সম্ভাব্য হেভিওয়েট প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। তারা দু’জন প্রার্থী থাকলে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে হলে এ নির্বাচন জমজমাট হবে। তবে কে বিজয়ী হবে তা এখনই বলা যাবে না। কারণ, নির্বাচনের আগে কেমন পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকবে তার ওপর হবে হিসাব-নিকাশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিঞ্জিরা আউলি এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ এলাকায় বিদ্যুৎ সমস্যা নেই। বর্তমান সংসদ সদস্য এলাকায় অনেক কাজ করেছেন। তবে এলাকার যে উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত ছিল।  
জিঞ্জিরা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা উত্তম চন্দ্র দাস বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ এলাকায় অনেক উন্নয়ন কাজ হয়েছে। তবে এলাকার একটি রাস্তার কাজ বাকি আছে। নসরুল হামিদ আরেকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে এলাকার আরও উন্নয়ন হবে। 
ঢাকা-৩ আসনের মনু বেপারি ঢাল এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মো. তাকিব বলেন, এ এলাকায় বর্তমান সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ যে পরিমাণ কাজ করেছেন, অতীতে আর কেউ তার মতো করেননি। তাই আমরা এলাকাবাসী মনে করছি আবারও তিনি নির্বাচিত হলে ভালো হয়। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা-৩ আসনের মধ্যবয়সী একজন ভোটার জানান, বর্তমান সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ একজন ভালো মানুষ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে এই এলাকায় বিএনপির অনেক ভোট রয়েছে। এলাকার মানুষ একটি সুষ্ঠু ভোটের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই বিএনপির প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় হোক আর যেই হোক নীরব ব্যালট বিপ্লব হবে।  
একটি  বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আবুল কাসেম বলেন, ঢাকা-৩ আসনে আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির অবস্থাও এ এলাকায় ভালো। তবে পর পর ৩ বার ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন কারণে মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষুব্ধ। তাই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল কি হয় তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

×