ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

সুনামগঞ্জ-১

আওয়ামী লীগের কোন্দলের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি

এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ ও আবির হাসান মানিক, তাহিরপুর

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আওয়ামী লীগের কোন্দলের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি

কালিদহ সাগরের বুকে জেগে ওঠা সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক সম্পদ

কালিদহ সাগরের বুকে জেগে ওঠা সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। ধান ও মৎস্য চাষে সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য উৎপাদনে যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি এ অঞ্চলের বালু-পাথর দেশের খনিজশিল্পকে করেছে সমৃদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে সুনামগঞ্জ পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
অসংখ্য মরমী সাধক, কবি, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক সুনামগঞ্জের এই মাঠিতে বেড়ে উঠেছেন। বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম, মরমী কবি হাসন রাজা,  বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, সুফি কবি সৈয়দ শাহনুর সাংস্কৃতিক পরিম-লে যেমন একেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, অপরদিকে কমরেড বরুণ রায়, আব্দুজ জহুর, আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একেকজন কিংবদন্তি।

ভারতের পদ্মভূষণ খেতাবপ্রাপ্ত উপমহাদেশের বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী যেমন দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবি মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা ও পর্যটন সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ জেলায় পাঁচটি সংসদীয় আসন রয়েছে। এর মধ্যে জামালগঞ্জ-তাহিরপুর-ধরমপাশা ও সদ্য ঘোষিত মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলার সবচেয়ে বড় আসন সুনামগঞ্জ-১। জনশ্রুতি রয়েছে, সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে যে দলের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, সে দলই সরকার গঠন করেছে। আসনটি তাই ম্যাজিক্যাল আসন হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।
সুনামগঞ্জ-১ আসনে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়লাভের আধিক্য দেখা গেছে বেশি। যে কারণে আসনটি আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি। এই আসন থেকে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বরুণ রায় প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন। তা ছাড়া বিগত নয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচবার, বিএনপির প্রার্থী দুবার, জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী একবার করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সারাদেশের মতো জাতীয় নির্বাচনের আগাম হাওয়া লেগেছে হাওড় অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ-১ আসনেও। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে গণসংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধান দুই দলের সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। কেন্দ্রে লবিং তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক অনুষ্ঠান, দলীয় সভা-সেমিনার, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিতি কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গণসংযোগ থেকে। 
খসড়া ভোটার তালিকা অনুসারে সুনামগঞ্জ-১ আসনে মোট ভোটার চার লাখ ৯১ হাজার ৫৫৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৫২ হাজার ৯৭৩ এবং নারী দুই লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৫ জন। গত নির্বাচনে এই আসনে ভোটকেন্দ্র ছিল ১৫০টি, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৯টিতে। 
এই আসনে ২০০৮ থেকে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। আওয়ামী লীগ থেকে সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গণসংযোগ ও কেন্দ্রে লবিং করলেও দলে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিভক্তি। অন্যদিকে নির্বাচন সামনে রেখে অনেকটা কৌশলে এগোচ্ছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। কোন্দল কম থাকায় বিএনপির প্রার্থীরা রয়েছেন সুবিধাজনক অবস্থানে। আগামী নির্বাচনে নৌকার শক্ত দুর্গ সুনামগঞ্জ-১ আসনটি বিএনপি তাই নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া। 
মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-১ আসনে মূলত ঘরের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ। এখানকার গৃহবিবাদ অনেকটাই তুঙ্গে। আর এ জন্য ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্যের ভূমিকাকে অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে। নেতারা বর্তমান এমপির সঙ্গে দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর দূরত্ব, পরিকল্পিত উন্নয়ন না হওয়া ও সুযোগ সন্ধানী নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলাসহ নানা বিতর্কিত কর্মকা-কে দায়ী করছেন। 
এর উল্টো সুর শোনা গেল ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিম আহমেদ বিলকিসের সঙ্গে কথা বলে। তিনি জানান, টানা তিন মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হয়ে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ-১ আসনে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন যে অভাবনীয় উন্নয়ন করেছেন, তাতে একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, এই আসনে নৌকার পরীক্ষিত মাঝি মেয়াজ্জেম হোসেন রতনকে দিয়েই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই কাজ করতে প্রস্তুত।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাফ ডজনের বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে সক্রিয়। আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ছাড়াও আলোচনায় রয়েছেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি শামীমা আক্তার খানম (শামীমা শাহরিয়ার), জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা মো. সেলিম আহমদ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা বিনয় ভূষণ তালুকদার ভানু।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম বৃহৎ দল। এখানে মান-অভিমান থাকবেÑ এটা স্বাভাবিক। শেখ হাসিনার হাত ধরে এই হাওড়াঞ্চলে যে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা এখন দৃশ্যমান। আর দলে দুষ্টু প্রকৃতির কিছু লোক আছে, যাদের তৃণমূলে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, তারাই আজ আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। দল এখানে অত্যন্ত সুসংগঠিত দাবি করে তিনি বলেন, এই আসন নৌকার ঘাঁটি হিসেবে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, আগামীতেও এর ব্যত্যয় হবে না।
প্রথমবারের মতো মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা সেলিম আহমদের গণসংযোগ ও সাংগঠনিক কর্মকা- সাড়া ফেলেছে নতুন করে। দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতিদিনই মতবিনিময়, উঠান বৈঠক ও পথসভা করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরছেন তিনি।
তৃণমূলকে সুসংগঠিত করার কাজেও বেশ তোড়জোড় দেখা গেছে।
এদিকে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত সরকার নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। আসনটিতে নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি তৃণমূল নেতাদের দীর্ঘদিনের এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, হাওড়াঞ্চলে পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি। এর জন্য তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন নেতৃত্ব নির্বাচন জরুরি। দলের ত্যাগীদের একপাশে রেখে কিছু সুযোগসন্ধানী হাইব্রিডকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান এমপির ওঠা-বসার কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।
সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি শামীমা আক্তার খানম (শামীমা শাহরিয়ার) এবারও এই আসন থেকে মনোনয়নের বিষয়ে আশাবাদী। গণসংযোগে তিনিও ব্যস্ত সময় পার করছেন। তিনিও এই আসনে সাংগঠনিক দ্বিধাবিভক্তির জন্য বর্তমান এমপির নানা বিতর্কিত কর্মকা-কে দায়ী করেছেন।
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক আলী মুর্তজা বলেন, দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বর্তমান এমপির অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ক্ষমতা পেয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখেন না তিনি। কর্মীদের সুখ-দুঃখের কথা না শুনে কিছু তোষামোদকারী সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজধানীতে ব্যস্ত সময় কাটান। নৌকার এই ঘাঁটি ধরে রাখতে হলে এখানে আওয়ামী পরিবারে বেড়ে ওঠা একজন ক্লিন ইমেজের নেতা নির্বাচন জরুরি।
তবে জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী দলে কোনো বিভেদ নেই দাবি করে বলেন, এত বড় দল, এখানে দুই-একজন ভিন্ন মতের থাকতেই পারে। তবে আমরা আশাবাদী, এই আসনে বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকেই তার কাজের মাধ্যমে আবারও দল মূল্যায়ন করবে।
সুনামগঞ্জ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সেলিম আহমেদ বলেন, নানা বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে বর্তমান এমপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের উন্নয়নের চিত্র এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতেও ব্যর্থ হয়েছেন বর্তমান এমপি।
অপরদিকে, বিএনপি নেতারা কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা মুখে না বললেও নির্বাচনী মাঠ ফাঁকা ছেড়ে দিতে নারাজ দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। বিএনপি থেকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের আলোচনায় রয়েছেন- সাবেক এমপি নজির হোসেন, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুল, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মো. আনিসুল হক ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল মোতালিব খান।
সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনয়নপ্রত্যাশী কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এই আসনে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশি সুসংগঠিত। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত। তবে আমরা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। এর পরিবর্তে সরকারের পতনের একদফা আন্দোলনকে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছি।

×