ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

শরীয়তপুরে পরিবারগুলো হাসিমুখ দেখার আশায়

-

প্রকাশিত: ০০:৫৮, ৭ জুলাই ২০২৩

শরীয়তপুরে পরিবারগুলো হাসিমুখ দেখার আশায়

ছিল টিনের ঘর হয়েছে ইটের দালান। প্রবাসীর কল্যাণে বদলে গেছে বাড়ির চিত্র

প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন শরীয়তপুরের দেড় লক্ষাধিক লোক। এর মধ্যে নারী শ্রমিকও রয়েছেন। জেলার নড়িয়া উপজেলার প্রায় ১ লাখ লোক ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, লিবিয়া, যুক্তরাজ্য, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন, ওমান, দুবাই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছেন। নিজ মাতৃভূমি রেখে প্রবাসে গিয়ে অনেকে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে যেমন কলাগাছ হয়েছেন, তাদের পরিবার-পরিজন সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করছেন আবার অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশ নামের সোনার হরিণে চড়তে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথের ভিখারী সেজেছেন। তবে ব্যর্থতার চেয়ে সফলতার পরিমাণ বেশি নিঃসন্দেহে। শরীয়তপুরে নড়িয়ার ইতালিপাড়াসহ প্রবাসীদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের সুখ-দুঃখের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। 
প্রবাস জীবন আকর্ষণীয় হলেও পেছনে থাকে নানা চড়াই-উৎরাই। কেউ হয়তো কর্মজীবনের কিছু সময়ের জন্য প্রবাসী হন, আবার কেউ সুখ-শান্তিতে সারা জীবন কাটাতে প্রবাসী হন। এ জীবন কারও জন্য সুখের, আবার কারও জন্য অতি দুঃখের। দেশ থেকে মানুষ বিদেশ যায় তার পরিবার-পরিজনকে, সংসারের বাকি লোকগুলোকে ভালো ও আনন্দে রাখার জন্য। কিন্তু দালাল নামক হিংস্র, নরপিশাচ অর্থলোভী কীটপতঙ্গের নিষ্ঠুর থাবায় অকালে ঝরে পড়ে  ম্লান হয়ে যায় সেই সুখের হাসিটুকু। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও প্রবাসীদের ভূমিকা কম নয়। প্রবাসের কর্মজীবীরা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানকে ভালো রাখার জন্যই রাত-দিন পরিশ্রম করে থাকেন। তাই প্রবাসের জীবন একটু ভিন্ন রকম। 
প্রবাসী জীবনের করুণ কাহিনী শুনালেন নড়িয়া উপজেলার জপসা গ্রামের হাবি ঢালীর পুত্র আরিফ ঢালী। তিনি জানান, গত বছর তার বড় ভাই বশিউর ঢালী বেকার জীবন থেকে বাঁচতে দালালের মাধ্যমে পাড়ি জমান লিবিয়া। কিছুদিন যেতে না যেতেই ২০২২ সালের ১৫ মার্চ একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। তখন তার ভাই বশিউর ঢালীর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। ফোনে তিনি জানান, কিছু লোক আমাকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে লিবিয়া নিয়ে আসছে। আমাকে তারা এখন বেধড়ক মারপিট করছে, আমাকে বাঁচাতে চাইলে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের আনোয়ারা খাতুনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ টাকা পাঠাও।

মোবাইল ফোনে আপন ভাইয়ের এমন বাঁচার আকুতি শুনে ২০২২ সালের ২১ মার্চ ওই অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। পরবর্তীতে ১ এপ্রিল আবারও তার ভাই ফোন করে জানায়, ওই আনোয়ারা খাতুনের অ্যাকাউন্টে আরও ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে, তা না হলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে, আমাকে বাঁচাও। ভাইকে বাঁচাতে আরিফ ঢালী ৫ এপ্রিল ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার রয়েল হোস্টেলের সামনে আনোয়ারা খাতুনের কাছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আসেন। তার কিছুদিন পর ১৭ এপ্রিল লিবিয়ায় বসবাসরত আরিফ ঢালীর এক চাচাতো ভাইয়ের বাসার সামনে তার ভাই বশিউর ঢালীর লাশ ফেলে রেখে গেছে।

আরিফ ঢালী জানান, তারা একদিকে ভাইয়ের শোক অন্যদিকে দেনা করা টাকা পরিশোধের কষ্টে পরিবারের অন্য সবাই রুগ্ন প্রায়। এরপর থেকে তাদের পরিবারের সকল আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। যদিও সান্ত¦নাস্বরূপ পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল শরীয়তপুর আদালতে মানবপাচার দমন আইনে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের আনোয়ারা খাতুনসহ আজ্ঞত ৫/৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলার ঘানি টানতে গিয়ে এখন পরিবারের সবাই নির্বিকার ও নিঃস্ব। 
ত্রিশ বছর ধরে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও গ্রামের রতন মোল্লা। মালয়েশিয়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তিনি। কিনেছেন গাড়ি, চলেন অনেকটা আরাম আয়েশে। আর্থিকভাবে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অন্যভাইদেরও মালয়েশিয়াতে জায়গা করে দিয়েছেন তিনি। মালয়েশিয়ার এই প্রবাসী মাঝে মধ্যেই দেশে চলে আসেন। তিনি বলেন, আপন জায়গা ফেলে একটু ভালো থাকার জন্য মানুষ পরবাসে চলে যান। কেন যান? আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাব বলে, বিদেশের মতো সুযোগ-সুবিধা নেই বলে, বেতন কম বলে ইত্যাদি কারণে। এই কারণগুলোও থাকত না, আমরা যদি আমাদের দেশের ভেতরের, দেশের মানুষদের জন্য যদি সঠিক উপায়ে সুষ্ঠু কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি করতে পারতাম।

এ নিয়ে আসলে একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়, কাজ করতে হবে সরকারকেও। দেশ থেকে প্রবাসে গিয়ে কি খুব ভালো থাকে কেউ? না, দেশ থেকে সবকিছু ছেড়ে যেমন তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যখন প্রবাসে একা একটা মানুষ যায় বা কাজ করে তখন তার মনটা কিন্তু পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই। মনে পড়ে তার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা, স্ত্রী-সন্তানের কথা। তখন তার আর কাজ করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পুনরায় দেশে চলে আসতে। কিন্তু না, সময় এবং পরিস্থিতি তা করতে দেয় না, কেননা সে যদি বিদেশ থেকে দেশে এসে পড়ে তবে তার আপন মানুষগুলো অর্থকষ্টে ভুগবে, তিনবেলার খাবার একবেলা খেতে হবে, কোনো কোনো বেলা আবার না খেয়েই থাকতে হবে।

এটা তার চোখের সামনে ঘটলে সে সহ্য করতে পারবে না। তাই শত যন্ত্রণার পরও দেশের মানুষটি প্রবাসে থাকে তার কষ্ট হলেও যাতে তার প্রিয় মানুষগুলো একটু ভালো থাকে, একটু স্বস্তিতে থাকে, একটু সুন্দর থাকে, সে যেন পরবর্তীতে দেশে ফিরে সে মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখতে পারে। আহা, তার কাছে তখনই পরম শান্তি বলে মনে হয়। মনে হয় এই মুহূর্তটার জন্যই তো দেশের বাইরে থাকা, খানিক কষ্ট করা।
ছয়গাঁও গ্রামের মৃত মরণ সরদারের তিন ছেলে রিপন, শিপন ও শফিক থাকেন ইতালি। পড়াশোনায় ভালো না হওয়াতে পিতা-মাতা ইতালি পাঠান তিন ছেলেকে। গত বিশ বছর ধরে প্রবাসে থেকে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারা। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে, নিজ বাড়িতে পাকাভবন নির্মাণসহ খুবই সুখ-শান্তিতে বসবাস করছেন তাদের পরিবার পরিজন। নেই কোনো পিছুটান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের এক আত্মীয় বলেন, যারা প্রবাসে চলে গেছেন দেশ ছেড়ে তাদের আপন মানুষজন ছেড়ে তাদের ভাবনায় শুধু একটা ভাবনাই থাকে, আমার মা ভালো আছে তো! আমার বাবা ভালো আছে তো! আমার সন্তানরা ভালো আছে তো! এই ভাবনাগুলো তাদের আরও ভাবিয়ে তোলে যে, তাদের যত কষ্টই হোক না কেন তাদের উপার্জন করতে হবে।

তখন তারা বুকে পাথরচাপা দিয়ে কাজে নেমে যায়, যে নেমে যাওয়ার মধ্যে আর কোনো দ্বিধা থাকে না, দ্বন্দ্ব থাকে না, থাকে শুধু একটাই ভাবনা যে, আমাকে ভালো কিছু করে দেশে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। যে ফোটানোর মধ্যে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, ক্লেদ থাকবে না, তৃষ্ণা থাকবে না, থাকবে না এর কোনোকিছু। কেননা তারা তাদের কথা ভেবে প্রবাসে যায় না, তারা তাদের পরিবারের কথা, দেশের কথা ভেবে বিদেশ যায়। গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। দেশ থেকে একজন মানুষ যখন প্রবাসে যায় তখন তার ভাবনায় সবচেয়ে আগে যে ভাবনাটা থাকে সেটা হলো আমাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যে অর্থ দিয়ে আমি বিদেশে এসেছি আমাকে তা শোধ করে পরিবারের জন্য কিছু নিয়ে দেশে ফিরতে হবে।

ভেদরগঞ্জ উপজেলার রানীসার গ্রামের আব্দুল মান্নান সরদার। নগদ টাকা ছাড়াও নিজের জমি বিক্রি করে তিন ছেলেকে মালয়েশিয়া ও সৌদিআরব পাঠিয়েছেন। ছেলেরা নিজের গ্রামে এসে বিয়ে-শাদি করে ভিন্ন ভিন্নভাবে ঘর-সংসার করছেন। কিন্তু পিতা-মাতাকে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে চান না কেউ। এ নিয়ে মাঝে-মধ্যেই দেন-দরবার হচ্ছে। সুখে নেই তারা।
বাপ্পীর বাবা আবুল বাসার কাজী জানান, তাদের সন্তান বাপ্পী মারা যাওয়ার পর পুরো জীবনটাই যেন তাদের এলোমেলো হয়ে গেছে। তিনি জানান, ২০২১ সালে নভেম্বর মাসে কামরুল হাসান বাপ্পী ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে দুবাই যান। পরে সেখান থেকে লিবিয়া যান। লিবিয়া থেকে ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি ট্রলারে উঠেন ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির কারণে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়। দুই দিন পর ইতালির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ট্রলারটি উদ্ধার করে।

×