ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

১৮৯০ সালের পরিকল্পনা চালু হচ্ছে ১৩২ বছর পর

আগামী বছর দোহাজারী কক্সবাজার ট্রেন চলবে

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৭ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৬:৫৫, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

আগামী বছর দোহাজারী কক্সবাজার ট্রেন চলবে

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রথম ১৮৯০ সালে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রথম ১৮৯০ সালে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, যা মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ১৩২ বছর পর এখন তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৭৭ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে রেলপথটি চালু হবে।

প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কক্সবাজারের রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কথা রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের আগ্রহের অভাবে দ্বিতীয় অংশের কাজ এখনো শুরু হয়নি বলে প্রকল্পের সূত্র জানায়।


রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় কক্সাবাজারে ঝিনুক আদলে একটি আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কক্সবাজার সরকারি কলেজের উল্টা পাশে এই স্টেশনটি নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। স্টেশনটির ছয় তলা ভবন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন অন্যান্য অবকাঠানো নির্মাণ করা হচ্ছে বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পের ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজারে আইকনিক রেলস্টেশনের ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এখন অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।’ ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ট্রান্স এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেলপথের অংশ হিসেবে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।


প্রকল্পটির কাজ ২০১০ সালের ১ জুলাই শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন তা ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পটি দুটি অংশে ভাগ করে নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত প্রথম অংশে যৌথভাবে কাজ করছে চায়নার সিআরইসি ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

এ ছাড়া চকরিয়া থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের কাজ যৌথভাবে করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়নার সিসিইসিসি ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে।

কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে রামু থেকে ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে না। তাই প্রকল্পের দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া এক হাজার ৩৯১ কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকল্পে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলক সিগন্যালিং সিস্টেম, ৩৯টি মেজর (বড়) ও ১৪৫টি মাইনর (ছোট) রেল সেতু এবং ৯৬টি লেভেলক্রসিং ও দুটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে।

এ ছাড়া রামু ও আশপাশের এলাকায় রয়েছে হাতির অভয়ারণ্য। ওই এলাকায় বুনোহাতি প্রায়ই দল বেঁধে চলাচল করে। অনেক সময় হাতি শুঁড় তুলেও পথ চলে। এ ক্ষেত্রে রেলপথ যাতে হাতির চলাচলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে, সে জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। তাই রেলপথে বিশেষ ধরনের সেন্সর বসাতে হয়েছে। যার ফলে হাতি রেলপথে থাকলে ট্রেনচালক ওই এলাকা অতিক্রমের আগেই তা বুঝতে পারবেন। হাতির বিষয়টি মাথায় রেখে জমির প্রয়োজন কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

১৩২ বছর আগে রেলপথটি নির্মাণে পরিকল্পনা হয় ॥ ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেওয়া হয় এই রেলপথ নির্মাণে। চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৩২ বছর আগে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি মিয়ানমার।
১৮৯০ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-০৯ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে সমীক্ষাও চালায়। এর পর ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। তখন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ নির্মাণ করা হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাকি রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রেলপথ আর হয়নি। এর পর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার একবার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে এ পথে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রকল্পটি নির্মাণে।

×