ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট চর হেয়ার ও সোনারচর

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ, পটুয়াখালী থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ০০:৪০, ১ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৬:৪৯, ১ ডিসেম্বর ২০২২

সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট চর হেয়ার ও সোনারচর

পটুয়াখালীর রাঙাবালী উপজেলার শেষ প্রান্তের সমুদ্রের তীরে জেগে ওঠা চর হেয়ারে সূর্যাস্তের অপরূপ

যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এবং প্রশাসনের উদ্যোগের অভাবে অবহেলিত রয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটন স্পট। পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার শেষ প্রান্তে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে জেগে ওঠা সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্রের নাম ‘সোনারচর’। পাশেই রয়েছে চর হেয়ার দ্বীপ ও জাহাজমারা সমুদ্র সৈকত। সবুজ বনায়ন, পাখির কলরব, বন্যপ্রাণীর ঝাঁক, জেলেদের উচ্ছ্বাস আর সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি মিলে নয়নাভিরাম প্রকৃতি সৌন্দর্যে ভরপুর এ সব চরাঞ্চল।

কিন্তু এ সব চরাঞ্চলে যাতায়াতের নেই কোন মাধ্যম। স্থানীয় একমাত্র ভরসা ইঞ্জিনচালিত নৌকা। কিন্তু তাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এছাড়া অসুস্থ রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নেই কোন হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি, বন ও চরাঞ্চলে প্রকৃতি সৌন্দর্যে ভরপুর থাকলেও কোন কাজে আসছে না বলে স্থানীয়রা জানান। তাই দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চরে নিয়মিত নদী খননেন মাধ্যমে লঞ্চ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর দাবি তাদের।

জাহাঙ্গীর নামের চরমোন্তাজ গ্রামের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজের সাত নম্বর ওয়ার্ড। সাগরে মাছ ধরা আমাদের প্রধান পেশা। তবে অনেকেই কৃষি কাজ করেন। কিন্তু সাগরের লবণ পানির কারণে জমিতে তেমন ফসল হয় না। এলাকা থেকে আগে ঢাকা আসার কোন লঞ্চ ছিল না। গলাচিপায় এসে লঞ্চে উঠতে হতো।

একদিন আগেই সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে বিকেলে ঢাকার লঞ্চ ধরতে হতো। এতে ঢাকা যেতেই দুইদিন চলে যায়। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায় না। সাগরের মাছ পরিবহনে নেই তেমন ব্যবস্থা। এই এলাকায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে কিন্তু যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই।’ চরাঞ্চল উন্নয়নে লঞ্চ ও স্পিডবোট সার্ভিস চালুর দাবি জানান তিনি।

চর হেয়ারে রয়েছে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ॥ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর উপজেলার সোনারচর ও চর হেয়ারে রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। কিন্তু যাতায়াতের কোন মাধ্যম না থাকায় এই সৈকতে কোন পর্যটক ও দর্শনার্থী নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জেলে নৌকায় মাধ্যমে চরে যাতায়াত করেন। কিন্তু সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসতে হয় নৌকা না থাকার কারণে। এই চরে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার একর আয়তনের পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। বিশাল বনাঞ্চল, সমুদ্র তীরে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। এই সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করা যায় বলে স্থানীয়রা জানান।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, নগর থেকে বহু দূরের এই সৈকতের সৌন্দর্য এখনও অনেকের কাছেই অজানা। সোনারচর ও চর হেয়ারের আকর্ষণ যে কোন মানুষকেই কাছে টানে। এখানে পা না ফেললে এটা বোঝার উপায় নেই বলে দর্শনার্থীর জানান।

আলমগীর নামে এক দর্শনার্থী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা থেকে আমরা ঘুরতে এসেছি। এই সমুদ্র সৈকতে একই স্থানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য। লাল কাঁকড়া দলের অসাধারণ শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে হরিণ, বুনো মহিষ, মেছো বাঘ, শূকর, ভোঁদড়সহ নানা প্রজাতির পশু-পাখি। শীত মৌসুমে স্থানীয় পাখির দলে যোগ দেয় হাজারো অতিথি পাখি। সাইবেরিয়ান হাঁস, সরাইল, গাঙচিলসহ নানা জাতের পাখির আগমন হয় এখানে। কিন্তু যাতায়াতের তেমন ব্যবস্থা না থাকার কারণে এই সৈকতের তেমন প্রচার নেই।’

ইঞ্জিনচালিত নৌকাই যাতায়াতের মাধ্যম ॥ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সোনারচরে রয়েছে অসংখ্য চ্যানেল। এসব চ্যানেলে পর্যটকরা ঘুরতে আসতে পারে। এ সব চরে একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যমে হলো ইঞ্জিনচালিত নৌকা (ট্রলার)। চ্যানেলের দু’পাশে একাধিক বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি চরের কোল ঘেঁষে অবস্থান মৌসুমি জেলেদের। শুকনো মৌসুমে নানা স্থান থেকে ব্যবসার জন্য এই চরটিতে আশ্রয় নেন অগনিত জেলে। এসব দেখে মনে হবে এক অন্যরকম জগৎ।
সোনারচরে স্বর্ণ না থাকলেও আছে সোনা রঙের বালু আর মৃদু বাতাসের নৃত্য। সকাল কিংবা শেষ বিকেলের রোদের আলো চরের বেলাভূমিতে পড়লে দূর থেকে পুরো দ্বীপটাকে সোনালি রঙের থালার মতো মনে হয়। বালুর ওপরে সূর্যের আলো পড়ে চোখের দৃষ্টিতে সোনারঙের আভা ছড়িয়ে যায়। মনে হবে দ্বীপটিতে যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বীপটির নাম ‘সোনারচর’ রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

সোনারচরে সরাসরি সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। জেলা শহর পটুয়াখালী থেকে গলাচিপা উপজেলায় পৌঁছাতে হবে দর্শনার্থীকে। সেখান থেকে আগুনমুখা নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে রাঙ্গাবালী উপজেলায়। এরপরে উপজেলার গহীনখালী খেয়াঘাট থেকে বুড়াগৌরাঙ্গ নদী পাড়ি দিয়ে ট্রালারে যেতে হবে সোনারচর। এছাড়াও কুয়াকাটা থেকে সরাসরি ট্রলার অথবা স্পিডবোট নিয়ে যাতায়াত করা যায়। তবে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-চরমোন্তাজ রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ সার্ভিস শুরু হলে সহজে ঢাকা থেকে এই চরে যাতায়াত করা যাবে বলে স্থানীয়রা জানান।

১২ বছর পর চালু হচ্ছে ঢাকা-চরমোন্তাজ লঞ্চ সার্ভিস ॥ এ সব চরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য দীর্ঘ ১২ বছর পর ঢাকা-চাঁদপুর-চরমোন্তাজ রুটে চালু হচ্ছে যাত্রীবাহী লঞ্চ সার্ভিস। ২০১০ সালে এই রুটে লঞ্চ চলাচল করতো। কিন্তু নদীর নাব্য সংকটের কারণে নৌ-পথটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এই রুটটি চালু হলে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সোনারচর ও হেয়ারচর সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের যাতায়াতের সহজ বলে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর ফলে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চে যাত্রী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তাই লোকসানে পড়তে হচ্ছে লঞ্চ মালিকদের। এ সমস্যা সমাধানের নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় নৌ-পথের নতুন রুট সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর এলাকায় যাত্রী ও পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিস চালু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

এর মধ্যে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-চাঁদপুর-চরমোন্তাজ রুটে চালু হবে নতুন লঞ্চ সার্ভিস কুয়াকাটা-১। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে এই লঞ্চ। দুটি কোম্পানির তিনটি লঞ্চ এই রুটে চলাচল করবে বলে বিআইডব্লিউটিএর সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ-ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় বরিশালে লঞ্চ যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে।

তাই লঞ্চগুলোতে যাত্রী সংকট সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। যেখানে কোন লঞ্চ ছিলনা। এছাড়া দুর্গম চরাঞ্চলে যাত্রী ও পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হচ্ছে। এর মধ্যে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-চরমোন্তাজ রুটে নতুন করে তিনটি লঞ্চের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কুয়াকাট-১ লঞ্চের মালিক আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিকভাবে তিনটি লঞ্চ দিয়ে এই সার্ভিসটি পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে প্রতিদিন ঢাকা থেকে একটি এবং চরমোন্তাজ থেকে একটি করে দুটি লঞ্চ চলবে। আর একটি লঞ্চ ঢাকার সদরঘাটে রাখা হবে। একদিন পর পর পরিবর্তন করে এই তিনটি লঞ্চ চলাচল করবে। যাত্রীদের চাহিদা আলোকে লঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

×