
সেরেনা উইলিয়ামস
ভেনাস বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় হবে। কিন্তু তুমি হবে সর্বকালের সেরা! বড় বোন ভেনাস উইলিয়ামসের নাম নিয়ে ছোট্ট সেরেনাকে বলেছিলেন তার বাবা। বাবার সেই অমূল্য কথাটি-ই বাস্তবে পরিণত হয়। অসাধারণ পারফর্মেন্সের সৌজন্যে নিজেকে বিশ্ব টেনিসের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান সেরেনা উইলিয়ামস। কৃষ্ণাঙ্গ বলে এক সময় যাকে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছিল শ্বেতাঙ্গদের হাতে। সেই সেরেনাই আজ বিশ্ব টেনিসের মহিলা এককের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়, অন্যতম সেরা এ্যাথলেট।
অবশেষে সেই সেরেনা যুগেরই অবসান ঘটল! টেনিস খেলার জন্যই পৃথিবীতে যার আবির্ভাব, সেই চ্যাম্পিয়ন বিদায় জানালেন নিজের র্যাকেটকে। ১৯৯৯ সালে ইউএস ওপেন জিতে শুরু হয়েছিল সেরেনা উইলিয়ামসের গ্র্যান্ডস্লাম জয়যাত্রা। নিজের দেশের সেই প্রিয় গ্র্যান্ডস্লামেই শেষ ম্যাচ খেলে ফেললেন তিনি। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে ২৩টি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের রেকর্ড গড়েছেন সেরেনা উইরিয়ামস। অলিম্পিকে জিতেছেন স্বর্ণপদক।
ইউএস ওপেন শুরুর আগেই বিদায়ের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেরেনা উইলিয়ামস। ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এটাই তার শেষের শুরু। ১৯৯৯ সালে যেখানে ইউএস ওপেন জিতেছিলেন অনেকের ধারণা ছিল, হয়ত এবার প্রথম ম্যাচেই বিদায় নেবেন তিনি। বিদায়ের ঘণ্টা বাজছিল, কান্নার জন্য মঞ্চও তৈরি ছিল। কিন্তু, সেরেনা হার মানতে জানেন না। তার জেদ বিদায়ের আয়োজনে জল ঢেলে দেয়।
ইউএস ওপেনের প্রথম রাউন্ডে জিতে দ্বিতীয় পর্বে জায়গা করে নেন তিনি। ফ্ল্যাশিং মিডোসের দ্বিতীয় ম্যাচে যেন আরও দুর্বার ৪০ বছরের এই তারকা। তিন সেটের কঠিন লড়াইয়েও জয় তুলে নেন আমেরিকান কিংবদন্তি। কিন্তু তৃতীয় পর্বেই জয়রথ থেমে যায় তার। যার ফলে এখান থেকেই বিদায় নিতে হয় বিশ্ব টেনিস র্যাঙ্কিংয়ের সাবেক এই নাম্বার ওয়ান তারকার। শনিবার কঠিন লড়াইয়ের পর অস্ট্রেলিয়ার এ্যাজলা টোমলজানোভিচের কাছে হেরে যান তিনি।
টোমলজানোভিচ এদিন ৭-৫, ৬-৭(৭/৪) এবং ৬-১ গেমে পরাজয়ের স্বাদ উপহার দেন সেরেনা উইরিয়ামসকে। এমন পরাজয়ের পর হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতরণ। কোর্টের মধ্যেই কেঁদে ফেলেন সেরেনা। চোখের জল যেন কিছুতেই বাঁধা মানেনি। হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল। হাসি-কান্নায় ফ্ল্যাশিং মিডোর যাত্রা শেষ করলেন বিশ্ব টেনিস র্যাঙ্কিংয়ের সাবেক নাম্বার ওয়ান এই তারকা।
২০১৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছিলেন সেরেনা উইলিয়ামস। সেইসঙ্গে কিংবদন্তি স্টেফি গ্রাফকে ছাড়িয়ে উন্মুক্তযুগে সর্বোচ্চ গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েন তিনি। সেই সময়েই অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সেরেনা। এরপর নিজেকে আর কোর্টে সেভাবে মেলে ধরতে পারছিলেন না আমেরিকান টেনিসের এই কৃঞ্চকলি।
র্যাকেট হাতে কোর্টে তার এতটাই বাজে সময় কাটছিল যে, চলতি মাসের শুরুতেই ক্যারিয়ারের শেষের শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন ৭৩টি শিরোপার মালিক। হারের পর তাই প্রসঙ্গটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে নিউইয়র্র্কে। এবার কী তাহলে র্যাকেট তুলে রাখছেন সেরেনা? ইউএস ওপেন থেকে বিদায় নেয়ার পর কোর্টেও এই প্রশ্ন করা হয় উইলিয়ামস পরিবারের ছোট মেয়েকে। তবে টেনিসের কিংবদন্তি সেরেনা অবশ্য রহস্যময় ভূমিকা পালন করলেন।
অপেক্ষাটা যেন আরও বাড়িয়ে দিলেন তার ভক্ত-অনুরাগীদের। আবারও ফিরবেন কীনা প্রশ্নের জবাবে সেরেনা বলেন, ‘আমার মনে হয় না। তবে পরে কী হবে সেটা আমি কিন্তু বলতে পারছি না।’ হারের পর কাঁদতে কাঁদতেই গ্যালারিতে উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন চলতি মাসেই ৪১ বছরে পা রাখতে যাওযা এই আমেরিকান তারকা। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা খুশির কান্না।’ আর্থার এ্যাশ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে সেরেনার জন্য বাজানো হয় টিনা টার্নারের গান, ‘সিম্পলি দ্য বেস্ট।’
সুদীর্ঘ ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে যারা তাকে সমর্থন জুগিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সেরেনা উইলিয়ামস। সেরেনার ভাষ্যমতে, অভিযাত্রাটা ছিল তার দারুণ রোমাঞ্চকর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অভিযাত্রাটা মজার ছিল। জীবনের সেরা অভিযাত্রা। যেসব মানুষ জীবনে একবারের জন্য হলেও আমাকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
এ সময় নিজের বাবা-মায়েরও প্রশংসা করেন তিনি, ‘বাবা-মায়ের জন্যই এ সবকিছুর শুরু হয়েছিল। সব সাফল্য তাদেরই প্রাপ্য।’ আর্থার এ্যাশ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ছিলেন সেরেনার বড় বোন ভেনাস উইলিয়ামস। সাতবারের গ্র্যান্ডস্লাম চ্যাম্পিয়ন ভেনাসই সেরেনার এই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অুনপ্রেরণা। তাই তো ভেনাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সেরেনা বলেন, ‘ভেনাস না থাকলে আমি সেরেনা হতে পারতাম না। ভেনাস তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার কারণেই সেরেনার জন্ম হয়েছে।’ সংবাদ সম্মেলনে সেরেনা বলেন, ‘আমি এখনও লড়তে পারি।
আমার মনে হয় আমি এবার মায়ের দায়িত্বটা আরও ভালভাবে পালন করতে পারব। সেইসঙ্গে সেরেনার অন্য সংস্করণকে উন্মোচন করতে পারব।’ এরপরই হাসতে হাসতে সেরেনা যোগ করেন, ‘এই পৃথিবীতে প্রযুক্তিগতভাবে আমি এখনও তরুণ। তাই জীবনটা উপভোগ করতে চাই। আমার সামনে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে।’ তবে সবকিছুর মধ্যেই সেরেনা ফের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন নতুন বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্লামেও দেখা যেতে পারে তাকে।
শেষবেলায় সেরেনার বন্দনায় মেতেছে গোটা দুনিয়া। কিংবদন্তি গল্ফ তারকা টাইগার উডস লিখেছেন, ‘কোর্টের বাইরে ও ভেতরে তুমিই সেরা সেরেনা।’ ভারতীয় ক্রিকেটের ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকর টুইটারে দীর্ঘ ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন সেরেনাকে। বিশ্ব টেনিসের সাবেক নাম্বার ওয়ান বিলি জিন কিং বলেন, ‘বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসাবে বিদায় নেবে সেরেনা।
ওর ক্যারিয়ার একাধিক তরুণ খেলোয়াড়ের অনুপ্রেরণা। ও চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বের খেলাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।’ আমেরিকার সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামাও কুর্নিশ জানান সেরেনাকে। টুইটে মিশেল লিখেন, ‘আমরা সত্যিই সৌভাগ্যবান। তোমার জন্য আমি গর্বিত। সকলকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।’