
.
‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থে ছিল গণযুদ্ধ। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের ফসল। পাকিস্তান পর্বে বঙ্গবন্ধু মুজিব ’৬৬ সালে ছয়দফা দাবি উত্থাপন করে সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী আন্দোলনের সূচনা করেন। পরিণামে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়। জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ২২ ফেব্রুয়ারি ৬৯ সালে মুক্ত করে। সেদিন স্লোগান উঠেছিল ‘জেলের তালা ভাঙব - শেখ মুজিবকে আনব, পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ।’ ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ তাকে বাঙালি জাতির পক্ষে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তারপরও পাকিস্তানের জান্তা সরকার ও কায়েমি গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। এর প্রতিবাদে সমগ্র বাঙালি জাতি ক্ষোভে -বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিব তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
কার্যত ৭ মার্চের ভাষণের পর সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু তার দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। ‘প্রত্যেক পাড়ায় প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন ।’ মূলত বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়ার পর সারাদেশের মতো গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগ এবং এর অন্তর্গত পাগলা অঞ্চলের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য, জয়নাল আবেদীন, শাহ বদরুল হক গেদু মিয়া, অধ্যাপক শেখ রেয়াজউদ্দীন আহমদ, বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মফিজুল হক, সাবেক সভাপতি গফরগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগ, ক্যাপ্টেন (অব) মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এমপি, আবুল হাশেম খান চেয়ারম্যান, আমীর হোসেন চেয়ারম্যান, আবদুল হাই চেয়ারম্যান, হালিম উদ্দিন চেয়ারম্যান, মাহমুদা সুলতানা মীরা প্রমুখের অব্যাহত প্রচেষ্টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৩১ এপ্রিল দক্ষিণ গফরগাঁয়ের ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে পাগলা থানা ঘোষণা করেন। ২০১২ সালের ২৩ মে পাগলা থানা আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। পাগলা থানা কার্যক্রমে আর্থিক অবদান রাখেন মো. আলাউদ্দীন- সভাপতি পাগলা উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি, ওবাইদুল্লা আনোয়ার বুলবুল, কামরুল হুদা মোর্শেদ, মনির হোসেন আকন্দ মনির, হাফিজ উদ্দিন আকন্দ, এ কে এম শামসুদ্দিন সরকার, ক্বারি মো. হাবিবুল্লাহ বেলালী, শেখ শাহাব উদ্দিন, শেখ মো. ইব্রাহিম খলিল, আবদুল মোতালেব মাস্টার, সাইদুর রহমান দেওয়ান প্রমুখ। পাগলা উপজেলা বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন মো. জালাল উদ্দীন, মাহতাব উদ্দিন মেম্বার, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাবুল, আশরাফুজ্জামান মুকুল, শাহজালাল সাজু ( ভিপি) প্রমুখ।
পাগলা থানার জন্য মো. ফয়জুল ইসলাম আকন্দ, মো. নজরুল ইসলাম আকন্দ, জালাল উদ্দীন আকন্দ, শামসুল হুদা, সিরাজুল হক, মোছা. লুৎফুন্নেছা, মো. শামস উদ্দিন, জালাল উদ্দীন সিং, শামস উদ্দিন সিং ও নুরুর রহমান মোট ৩.০১ একর জমি দান করেন।
কার্যত গফরগাঁও থানা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভূমিকা পালন করেন দক্ষিণ গফরগাঁও অর্থাৎ পাগলা অঞ্চলের লোকজন। ৭ মার্চের ভাষণের পরদিন কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইদুর রহমান সিরাজ, তৎকালীন ময়মনসিংহ মহকুমা ও গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মফিজুল হক। কুরচাই মধ্যপাড়া, অললী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ও তললী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদের উদ্যোগে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। মশাখালী রেল স্টেশনসংলগ্ন চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা মাঠে আরফান আলী চেয়ারম্যান, ওমর উম্মিয়া তালুকদার, শফিকুল আমীন খসরু, সেলিম আহমেদ, সাইদুর রহমান কামাল প্রমুখের উদ্যোগে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়। গফরগাঁও ইসলামিয়া মাঠে আবুল হাশেম এমপিএ, সাইদুর রহমান সিরাজ, মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান, বেলাল আহমেদ (শহীদ), আ. সালাম, আ. গফুর, বদরুল আহমেদ, এয়াকুব আলী, আবু নছর প্রমুখ।
২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে গণহত্যা চালায়। এদিন রাত ১২টার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের সর্বশেষ ভূমি শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। পরদিন টেলিগ্রাম মারফত সংবাদ পাওয়ার পর আবুল হাশেম এমপিএ গফরগাঁও বাজারে মাইকিং করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন।
এদিকে সাইদুর রহমান সিরাজ, মো. মফিজুল হক, মনির উদ্দিন ফকির, অধ্যক্ষ মেজবাহউদ্দিন, ইউনুস আলী মাস্টার, এমদাদুল হক প্রমুখ গয়েশপুর মাদ্রাসায় ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করেন। ক্যাম্পের নেতৃবৃন্দ ঢাকা থেকে মৃত্যু ও প্রাণভয়ে ছুটে আসা উদ্বাস্তু মানুষজনকে আশ্রয়, খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এদিকে মেজর শফিউল্লাহর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈনিক সুবেদার মেজর সুলতান ও বাশারের নেতৃত্বে সৈনিকদের একটি গ্রুপ গয়েশপুর মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করেন। তারা সুতিয়া নদীর উত্তর তীর ঘেঁষে উজান ত্রিমোহনী থেকে কেল্লার পাড় পর্যন্ত অনেকগুলো ব্যাংকার স্থাপন করেন। একইভাবে মশাখালী ও লঙ্গাইরের নেতৃবৃন্দ মশাখালী হাইস্কুল ও চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে উদ্বাস্তু লোকজনকে সহযোগিতা করেন।
১৭ এপ্রিল দুপুর বেলা পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ-গয়েশপুর বাজারে বোমাবর্ষণ করে। সুবেদার মেজর বাশার ও সুবেদার মেজর সুলতানের নেতৃত্বে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। একই দিন পাকিস্তান বাহিনী গফরগাঁও বাজার ও ময়মনসিংহ শম্ভুগঞ্জ ব্রিজে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এদিন গফরগাঁও পাকিস্তান বাহিনীর বোমাবর্ষণে আবদুল বেপারি ও যমুনার মাসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। সন্ধ্যার দিকে মো. সেলিমের নেতৃত্বে, অনিল, রবি, আনিছ, মকবুল, সিরাজ কমান্ডার, মনসুর, হাবিব, মতিন ও কছিম উদ্দিন প্রমুখ গফরগাঁও থানায় আক্রমণ করে। তাদের গ্রুপ গফরগাঁও থানা থেকে ৫টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল সংগ্রহ করেন।
কার্যত গফরগাঁও থানার বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। অধিকাংশ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সাফল্যের সঙ্গে জয়লাভ করে। এ সকল যুদ্ধের মধ্যে শুধু রসুলপুরের আমলিতলা রাজাকার ক্যাম্প দখলের যুদ্ধ উত্তর গফরগাঁওয়ে অবস্থিত। গফরগাঁও এর পাগলা অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো- বাশিয়া রাজাকার ক্যাম্প, দত্তের বাজার ক্যাম্প স্থাপন, দক্ষিণ পাড়া যুদ্ধ, ফরচুঙ্গী-শিলার রেল ব্রিজ ও মশাখালী স্টেশন ক্যাম্পের যুদ্ধ, নয়াবাড়ির যুদ্ধ, বারইগাঁও ক্যাম্প আক্রমণ, গৈয়ারপাড়ের যুদ্ধ, সুতারচাপরের যুদ্ধ, গয়েশপুর-কাচারি ফটুয়া টেকের যুদ্ধ, প্রসাদপুর মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটির পতন, সীমাখালী খালের দ্বিতীয় যুদ্ধ ইত্যাদি।
কার্যত ৬ ডিসেম্বর নগরপাড়ার যুদ্ধের মাধ্যমেই গফরগাঁও এর দক্ষিণ অঞ্চল থেকে পাকিস্তান বাহিনীর পলায়ন পর্ব শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর সেকশন কমান্ডার আ. রহিমের নেতৃত্বে আইয়ুব আলী, হাফিজ উদ্দিন, সুরুজ, শামস উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন সরকার, নাজিম উদ্দীন খান, গিয়াস উদ্দিন খান, ওয়াদুদ খান, রশিদ ও খোকন মাঝি নগরপাড়ায় অবস্থান নেয়। তাদের গ্রুপ নদীর ওপাড়ে বেলদিয়া অবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। বেশ কিছুক্ষণ দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। একটি পর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনী নিজের অবস্থান ছেড়ে কাওরাইদের দিকে মুভ করে। প্রত্যক্ষদর্শীগণ সেখানে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখতে পায়। ৮ ডিসেম্বর ঘোলাঘাটে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর একটি গ্রুপ আবার নিগুয়ারীর দিক থেকে সেকশন কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন ও এমপি) ও শামসুল ইসলাম খান প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি গ্রুপের সঙ্গে খন্ড যুদ্ধ হয়। ৮ তারিখ রাতেই পাকিস্তান বাহিনী ট্রেনযোগে কাওরাইদ রেল স্টেশনের অবস্থান ছেড়ে গফরগাঁও চলে যায়। অন্যদিকে ৯ তারিখ সকাল বেলায় পাকিস্তান বাহিনী গফরগাঁও এর দখল ছেড়ে দিয়ে ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ চলে যায়। এই সংবাদ পেয়ে পালের বাজার ক্যাম্প থেকে ইকবাল - ই- আলম কোম্পানি ও ভালুকা থেকে সিরাজুল হক কমান্ডার প্রায় একই সময় গফরগাঁওয়ের দখল নেয়।
গফরগাঁও থানার মুক্তিবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংগঠকদের মধ্যে প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক দক্ষিণ গফরগাঁও অর্থাৎ পাগলা অঞ্চলের সন্তান। বর্তমান গফরগাঁও এর উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠকদের মধ্যে নিঃসন্দেহ আবুল হাশেম এমপির নাম শীর্ষে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছিল ১১টি সেক্টর। একইভাবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১১টি জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়। তন্মধ্যে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনী অঞ্চল নিয়ে উত্তর পূর্ব জোন-২, যার প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার ছিল ত্রিপুরার সাব্রুমে।
এই জোনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হোন চট্টগ্রামের জহুর হোসেন চৌধুরী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচিত গফরগাঁও এর দীঘা গ্রামের ড. এস এ সামাদ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি রাঙামাটির এসডিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আবার বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা অঞ্চল নিয়ে গঠিত দক্ষিণ পশ্চিম জোন ১ । এই জোনের সদর দপ্তর স্থাপিত হয় পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে। চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচিত হন চর আলগীর আবদুল মোমেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি পটুয়াখালী মহকুমার এসডিও ছিলেন। স্থানীয়ভাবে সংগঠিত ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের একজন গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মো. সিরাজুল হক। তার কোম্পানির একজন অসম সাহসী যোদ্ধা হলেন মো. সিরাজুল হক (শহীদ) । তিনি ২০ নভেম্বর ভালুকার ৯ নং বাঁধ এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একা দীর্ঘক্ষণ শুয়ে বসে, ক্রলিং করে কখনো কখনো দাঁড়িয়ে শত্রু পক্ষকে ঠেকিয়ে রাখেন, যাতে সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধাগণ নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন। একটি পর্যায়ে তার হাতে থাকা রাশিয়ান এলএমজি গরম হয়ে বিকল হয়ে যায়। এদিকে তিনি আবার বিলের আঠালো কাঁদায় আটকে যান। হানাদার বাহিনী তাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করে। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন জানাজা শেষে তাকে ঢালু গ্রামে কেমুখা বাড়ির জামে মসজিদসংলগ্ন পুকুর পাড়ে সমাহিত করেন। তিনি গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মফিজুল হকের সহোদর ছোট ভাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় গফরগাঁও কলেজে বিএসসি ১ম ব্যাচের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। কলেজ গেটে তার নাম খোদাই হলেও এখন প্রায় মুছে যাওয়ার উপক্রম।
গফরগাঁও অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার ও রাজনৈতিক সংগঠকদের অধিকাংশ দক্ষিণ গফরগাঁও অর্থাৎ পাগলা থানা অঞ্চলের সন্তান। তাঁরা শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মধ্যে এমন দুজন আছেন যাঁরা জাতীয় স্বীকৃতির দাবি রাখে। তাদের একজন হলেন আর এম সায়ীদ, জন্ম গ্রহণ করেছেন দক্ষিণের একটি গ্রাম বামুনখালীতে। ১৯৫৮ সালে জামালপুর জেলা স্কুল রোডে জামালপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আসাদ খোকার উদ্যোগে গঠিত হয় পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট। অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আলী আসাদের পিতা তসির উদ্দিন মোক্তার, আর এম সায়ীদ, এজাম উদ্দিন তালুকদার, আলতাফ উদ্দিন তালুকদার প্রমুখ। আর এম সায়ীদসহ পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের নিরুৎসাহিত করেন এবং তাফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া নিশ্চুপ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন করার তাদের এই সাংগঠনিক তৎপরতাকে সমর্থন করেছিলেন। তাদের বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। আর এম সায়ীদসহ পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ভারতে যান রাজনৈতিক ও লজিস্টিক সাপোর্ট আদায়ের জন্য। সেখানে তাঁদের কারাবরণও করতে হয়। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গফরগাঁওসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধকে সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত করেন। এগুলো করতে যেয়ে তিনি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তি বিক্রি করে দেন। বামুনখালী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাশিয়া গ্রামে আর একজন মহান মানুষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. খুরশিদ উদ্দিন আহমদে (অবঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আগরতলা হাবুল ব্যানার্জীর লিচু বাগানে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের যে হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল, তার অর্গানোগ্রাম করেন।
গফরগাঁও-ভালুকা থেকে নির্বাচিত অধ্যাপক শামসুল হুদা এমএনএ শহীদ নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আগরতলা সোনার বাংলা যুব শিবিরের ক্যাম্প চিফ ছিলেন। অবশ্য তিনি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা ছাড়া খুব বেশি দায়িত্ব পালন করেননি। তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান সিরাজ যমুনা যুব শিবিরের উপপ্রধান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন।
সোনার বাংলা যুব শিবিরের উপপ্রধান অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে গফরগাঁও থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। মো. মফিজুল হক গফরগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগ ও ময়মনসিংহ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে তিনি হাঁপানিয়া ক্যাম্পের পলিটিকাল মটিভেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। পরবর্তীতে তাঁকে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর কমান্ডের অধীনে ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি ও এম এ কাদির কোম্পানি মুক্তি যুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। মো. শামসুদ্দিন আহমেদ (সুব্রামনিয়াম)। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ডা. হাফিজ উদ্দিন খান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি মেঘালয়ের তুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক কাঠামোতে সদস্য ছিলেন। শফিকুল আমীন খসরু নাজমুল হক তারা ব্যাটালিয়ানের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। সেলিম আহমেদ ফজলুল হক গ্রুপের যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এভাবে কার্যত গফরগাঁওয়ের পাগলা অঞ্চলের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেন।
লেখক : শিক্ষক