
কানাডার রকি পাহাড়ঘেরা মনোরম শহরে চলমান জি-৭ সম্মেলন থেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই বেরিয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের উত্তেজনা বাড়ার প্রেক্ষিতে সোমবার রাতে তিনি সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন। এর আগে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দেন ট্রাম্প, যা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন খাতকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেবে।
জি-৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা চেষ্টা করেছেন, পাঁচ দিন ধরে চলা সংঘাত ঠেকাতে কোনো সমন্বিত কৌশল খুঁজে বের করার। ইসরায়েল ও ইরানে প্রাণহানির ঘটনা ইতোমধ্যেই ডজন ছাড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “তেহরানকে এখনই তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে হবে, না হলে খুব দেরি হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, ইরানের নেতারা “আলোচনায় আসতে চায়”, কিন্তু গত ৬০ দিনের মধ্যে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় ইসরায়েল চার দিন আগে বিমান হামলা শুরু করেছে। ট্রাম্পের মন্তব্য, “তাদের একটা চুক্তিতে আসতেই হবে।”
কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও সম্মেলনের আয়োজক মার্ক কার্নি বলেন, “আমরা ইতিহাসের এক মোড় ঘোরানোর সময় একত্র হয়েছি। বিশ্ব এখন আরও বিভক্ত ও বিপজ্জনক।”
রবিবার রাতে সম্মেলনে পৌঁছেই এক ঘণ্টার একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্জ।
চ্যান্সেলর মের্জ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সম্মেলনের শেষ ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলব, ইরানকে কোনো অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপাদান অর্জনের সুযোগ দেওয়া যাবে না।”
সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ট্রাম্প কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ইরান এই যুদ্ধে জিতছে না। তাদের এখনই কথা বলা উচিত, এর আগেই দেরি হয়ে যায়।”
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা
সম্মেলনের ফাঁকে সোমবার ট্রাম্প ও স্টারমার যুক্তরাজ্যের অটো ও অ্যারোস্পেস শিল্পের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনার নতুন একটি বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দেন। যদিও ইস্পাত খাত নিয়ে আলোচনা এখনও চলছে।
ট্রাম্প বলেন, “এই চুক্তি উভয় দেশের জন্যই ন্যায্য। এটি চাকরি ও আয় বৃদ্ধি করবে।” স্টারমারও বলেন, “এটি শক্তির প্রকাশ, এবং আমাদের দুই দেশের জন্যই একটি ভালো দিন।”
এ চুক্তির আগে গত মে মাসে উভয় দেশের নেতারা একটি প্রাথমিক কাঠামোগত চুক্তি ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে ব্রিটিশ গাড়ি, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক কমানোর বিনিময়ে মার্কিন গরুর মাংস ও ইথানলের মতো পণ্যে যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানো হবে।
তবে সোমবারের চুক্তিটি শুধুমাত্র গাড়ি ও অ্যারোস্পেস পণ্যের ওপর সীমাবদ্ধ। স্টিল খাতের বিষয়ে আলাদা আলোচনা প্রয়োজন হবে।
লন্ডনের মতে, এই চুক্তির ফলে রোলস রয়েসসহ ব্রিটিশ বিমান ইঞ্জিন ও বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাবে, যা তাদের জন্য বড় একটি প্রণোদনা।
জি-৭ সম্প্রসারণে রাশিয়া ও চীনকে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব ট্রাম্পের
সম্মেলনে ট্রাম্প আরেকটি বিতর্ক তৈরি করেন, যখন তিনি বলেন জি-৭ কে আবার জি-৮ বা এমনকি জি-৯ এ রূপান্তর করা উচিত, যেখানে রাশিয়া ও চীন অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ডেমোক্রেটিক দেশগুলোর এ গ্রুপে স্বৈরশাসিত রাশিয়া ও চীনকে যুক্ত করার প্রস্তাবে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়। ট্রাম্প বলেন, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করাটা ছিল “একটি বড় ভুল।”
মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্পের এমন মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, “জি-৭ ছিল গি-৮। বারাক ওবামা ও ট্রুডো চায়নি রাশিয়া থাকুক।” যদিও ২০১৪ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্টিফেন হার্পার, ট্রুডো পরে নির্বাচিত হন।
ট্রাম্পের মন্তব্য, “আমার মনে হয়, রাশিয়া থাকলে এখন যুদ্ধ হতো না। যদি চার বছর আগে আমি প্রেসিডেন্ট থাকতাম, তাও যুদ্ধ হতো না। ওরা রাশিয়াকে বের করে দিয়েছিল, যা ছিল বড় ভুল।”
চীনকে জি-৯ এ যুক্ত করার বিষয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে ট্রাম্প বলেন, “খারাপ আইডিয়া না। আমি আপত্তি করব না যদি কেউ শুধু চীনকেও নিতে চায়।”
তিনি আরও বলেন, “সম্মেলনগুলোতে বিশ্বনেতাদের একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকা জরুরি। পুতিন আমার সঙ্গে কথা বলে। অন্য কারও সঙ্গে নয়। ও রেগে গিয়েছিল যখন জি-৮ থেকে ওকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আমিও হলে হতাম।”
বিশ্ব রাজনীতির ক্রান্তিকালে যখন একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা, অন্যদিকে বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন সমীকরণ ঠিক তখনই জি-৭ সম্মেলনে ট্রাম্পের একের পর এক মন্তব্য ও পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্ক, কূটনৈতিক সমীকরণ ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কোন পথে গড়ায়, সেটাই এখন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নজরে।
সূত্র:https://tinyurl.com/2u3affs4
আফরোজা