
ছবি: জনকণ্ঠ
২০১৮ সালের জুলাই মাসে একনেকের এক সভায় "১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন" শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রায় ৪৪২ কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার টাকার এই প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ২৮০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমির আনুষঙ্গিক কাজ সম্পাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
প্রতিটি বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ৮০ লাখ এবং ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এই প্রকল্পের অধীনে নীলফামারী জেলার ছয়টি উপজেলার মোট ৯টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের কথা ছিল। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, ছয় বছর পার হলেও জেলার ডিমলা, ডোমার, সদর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলার ৪টি বধ্যভূমি আজও অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
নীলফামারীর ৯টি বধ্যভূমির মধ্যে বাস্তবায়িত ছয়টি হলো: জলঢাকা উপজেলার গোলনা কালিগঞ্জ বধ্যভূমি, ডোমার উপজেলার চিলাহাটি ভোগদাবুড়ি বধ্যভূমি ও মির্জাগঞ্জ খানপাড়া বধ্যভূমি, সদর উপজেলার খালিশাপাড়া (চৌধুরীপাড়া) বধ্যভূমি (প্রসঙ্গত, সদর উপজেলার শুটিপাড়া ও খালিশাপাড়ার দুটি নামই প্রতিবেদনে এসেছে, যা বাস্তবায়নের তালিকার সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক), সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ও গোলাহাট বধ্যভূমি।
তবে চারটি বধ্যভূমির কাজ এখনও শুরু হয়নি। সেগুলো হলো: ডিমলা উপজেলার শুটিবাড়ী বাজার বধ্যভূমি, ডোমার উপজেলার পশ্চিম বোড়াগাড়ী বধ্যভূমি, কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি বসুনিয়াপাড়া বধ্যভূমি এবং সদর উপজেলার শুটিপাড়া/খালিশাপাড়া বধ্যভূমি।
ডিমলা উপজেলার শুটিবাড়ী বাজার বধ্যভূমি: উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে কুমলাই নদীর তীরে অবস্থিত এই বধ্যভূমিতে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শায়িত আছেন। ২০২০ সালে প্রশাসন বৃহত্তর এলাকা জুড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে বধ্যভূমির উত্তরে নদী এবং দক্ষিণে একটি হোটেল গড়ে উঠেছে। হোটেল থাকার কারণে স্থানটি কার্যত একটি মূত্রত্যাগের স্থানে পরিণত হয়েছে, যা শহীদদের প্রতি চরম অবমাননার সামিল।
গণপূর্ত বিভাগ, নীলফামারীর মতে, জায়গাটি নদীর তীরে হওয়ায় অনেক নিচু। ১৯ শতক জমি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও, মাটি ভরাট ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালককে জানানো হলেও জমি সংক্রান্ত সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুল হক ও আব্দুল মালেকের মতে, নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরার এই পবিত্র স্থানটি দখল ও অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তারা দ্রুত এটি সংরক্ষণের দাবি জানান।
ডোমার উপজেলার পশ্চিম বোড়াগাড়ী বধ্যভূমি: উপজেলার চান্দিনাপাড়া গ্রামের এই বধ্যভূমিটি বর্তমানে মিজানুর রহমান ও আব্দুল মতিন নামে দুই ব্যক্তির দখলে রয়েছে। সেখানে এখন বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করা হচ্ছে, যার ফলে বধ্যভূমির কোনো অস্তিত্বই আর অবশিষ্ট নেই।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সাকিউজ্জামান জানিয়েছেন, এই বধ্যভূমির জায়গা অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষের দিকে এবং দ্রুতই মূল কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি বসুনিয়াপাড়া বধ্যভূমি: এই বধ্যভূমিটির অবস্থাও শোচনীয়। স্থানীয় এক টেলিকম ব্যবসায়ীর বাসভবন নির্মিত হয়েছে এখানে। এলাকাবাসীর ভাষ্য মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে ধরে এনে এখানে সারিবদ্ধ করে হত্যা করা হতো।
সদর উপজেলার শুটিপাড়া বধ্যভূমি: এই স্থানটি বর্তমানে লুৎফর রহমান নামে এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে এবং সেখানে তিনি বাঁশঝাড় লাগিয়েছেন। লুৎফরের দাবি, এটি তার পৈতৃক সম্পত্তি এবং এখানে কখনো কোনো ক্যাম্প বা হত্যাকাণ্ড ঘটেনি।
স্থানীয় আজিজুল ইসলাম এই দাবির বিরোধিতা করে বলেন, এই বাঁশঝাড়েই তার বাবাকে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং স্টেশন পাড়ার বোচা বাবুসহ অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, স্থানটি সংরক্ষণ করা হলে সবাই এর গুরুত্ব বুঝত এবং শহীদদের সম্মান জানাতো।
নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সাকিউজ্জামান জানান, ডিমলার শুটিবাড়ী বাজারের বধ্যভূমি নদী শ্রেণির জমি এবং নিচু হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত বাজেট প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে, কিশোরগঞ্জের বাহাগিলি, পশ্চিম বোড়াগাড়ী বধ্যভূমি ও সদরের শুটিপাড়ার বধ্যভূমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হওয়ায় জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ পর্যায়ে। অধিগ্রহণের বরাদ্দ পেলে কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
শহীদ