
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনিবার্য নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সুবাতাস যোগ করে তিনি হয়ে আছেন প্রাতঃস্মরণীয় এক কবি প্রতিভা। কবিতায় কেবল নয়, বাংলা নাটকেও শ্রী মধুসূদন আধুনিকতার উদ্গাতা। বাংলা নাট্যসাহিত্যে তিনি সামান্য যে কটি নাটক যোগ করেছেন, তাই দিয়ে তিনি নাট্যসাহিত্যেও অমরত্ব পেয়েছেন। আজ আমি শ্রী মধুসূদনের বাংলা নাটকগুলো নিয়ে সামান্য আলোকপাত করে বুঝতে চেষ্টা করব কোথায় তাঁর শক্তির উৎস।
আগেই বলেছি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটকের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যার ভেতর দুটি আবার প্রহসন। যদি আমরা স্মরণ করতে চাই, দেখব তাঁর নাটকগুলো হলো- শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, মায়াকানন এবং হেক্টর বধ; প্রহসনগুলো হচ্ছে- একেই কি বলে সভ্যতা? এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ; এছাড়াও তিনি রচনা করেন জরুরধ, জধঃহধাধষর, ঝবৎসরংঃধ, ঘরষ উধৎঢ়ধহ ইত্যাদি ইংরেজি নাটক। তাঁর উল্লেখিত নাটকগুলোর মধ্যে হেক্টর বধকে নাটক অভিধায় চিহ্নিত না করলেও চলে। কারণ, এটি আসলে গ্রিক মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়ড’ কাব্যের উপাখ্যান ভাগ-এর অনুবাদ। নানান বিবেচনায় আমার আলোচনার সীমায় থাকবে শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী, মায়াকানন, একেই কি বলে সভ্যতা? এবং বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ; এই ছয়টি বাংলা নাটক। আলোচনার সূত্র ধরে যদি কোনো ইংরেজি নাটকের প্রসঙ্গ এসে যায়, সেটি ভিন্ন কথা; তবে আমার আলোচনা তাঁর ছয় বাংলা নাটকে সীমাবদ্ধ রাখতেই সচেষ্ট থাকব।
আমরা যদি বাংলা নাটকের ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখব হেরাসিম লেবেডফ নামের একজন রুশ দেশীয় আগন্তুক ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে রঙ্গালয় স্থাপন করেন এবং ইংরেজি ‘ঞযব উরংমঁরংব’ নামক নাটকটি বাংলায় রূপান্তর করে ‘কাল্পনিক সংবদল (ছদ্মবেশী)’ নামে মঞ্চায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন; তাঁর হাত ধরেই বঙ্গদেশে আধুনিক বাংলা নাটকের গোড়াপত্তন হয়; তারপর যাঁদের যেসব নাটক অভিনীত হয়েছে বাংলায়, তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের নাম, যেটি ১৮৩৬-এর ৬ অক্টোবর অভিনীত হয়েছিল শ্যামবাজারের নবীন বসুর বাড়িতে; যদিও এ নিয়ে নাট্যবেত্তাদের মধ্যে মতভেদ আছে; কারও কারও মতে, যোগেন্দ্র চন্দ্র গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ এবং তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ নাটক দুটিই প্রথম অভিনীত বাংলা নাটক; যদিও দুটি নাটকই ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে রচিত এবং অভিনীত হয়।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহিত্য-ঐতিহাসিকের মতে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে নতুন বাজারের রামজয় বসাকের বাড়িতে মঞ্চায়িত রামনারায়ণ তর্করতœ রচিত ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ই প্রথম বাংলা মৌলিক নাটক। একই নাট্যকারের ‘নব নাটক’ (১৮৬৬) নামে আর একটি নাটক ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিরচিত ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৫৮) নাটকটিকেই বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাসে প্রথম বাংলা আধুনিক নাটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমসাময়িককালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পন’ (১৮৬০) প্রতিবাদী নাটক হিসেবে বাংলা নাটকের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নাটকটি বেনামিতে মুদ্রিত হওয়ার পর যখন বিভিন্নস্থানে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হতে থাকে; তখন বাধ্য হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে ১৮৬৭তে ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ পাস করতে হয়।
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতেই পারি, বাংলা নাট্যচর্চার সূচনাপর্বে যাঁদের হাতে বাংলা নাটকের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তাঁদের অন্যতম শ্রী মধুসূদন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। প্রথম সংস্করণে নাট্যকার মধুসূদন কবিতায় একটি প্রস্তাবনা লেখেন; যেখানে বলেন-
(রাগিণী খাম্বাজ, তাল মধ্যমান)
মরি হায়, কোথা সে সুখের সময়,/ যে সময় দেশময় নাট্যরস সবিশেষ ছিল রসময়।/ শুন গো ভারতভূমি,/ কত নিদ্রা যাবে তুমি,
আর নিদ্রা উচিত না হয়।/ উঠ ত্যজ ঘুম ঘোর/ হইল, হইল ভোর,/ দিনকর প্রাচীতে উদয়।/ কোথায় বাল্মিকী, ব্যাস/ কোথা তব কালিদাস,/ কোথা ভবভূতি মহোদয়।/ অলীক কুনাট্য রঙ্গে/ মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,/ নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।/ সুধারস অনাদরে,/ বিষবারি পান করে,/ তাহে হয় তনু মনঃ ক্ষয়।/ মধু বলে জাগ মা গো,/ বিভু স্থানে এই মাগ,/ সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয় ॥/ ইতি।
(ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত শর্মিষ্ঠা নাটক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, চতুর্থ সংস্করণ কলিকাতা ১৩৬৪, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।)
শ্রী মধুসূদন রচিত ‘প্রস্তাবনা’ পাঠে আমাদের মনে সঙ্গত কারণেই প্রশ্নের জন্ম হয়, তবে কি মধুসূদন দত্ত তাঁর সমসাময়িক নাট্যকারদের নাট্য-প্রতিভাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন? আমার মনে হয় না। বরং মনে হয়, বাংলার লোকজীবনে বহুল প্রচলিত নাট্যরস সমৃদ্ধ যে অনুষঙ্গগুলো দীর্ঘকাল বাংলার লোকমানস তাদের জীবনাচারে লালন করে এসেছে, নবনাট্যচর্চায় তার অনুপস্থিতি তাঁকে ব্যথিত করেছে। বাংলার পালাগান, কীর্তন, গাইনের গীত, ঢপযাত্রা, কবিগান, টপ্পা, পাঁচালি, কথকতা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে আমাদের নাটক বিকশিত হয়নি, সেটা হয়ত শ্রী মধুসূদন মেনে নিতে পারেননি; কিন্তু তিনি যে তাঁর নাটকে আবহমান বাংলার লোকধারাকে সমন্বয়ের প্রয়াস চালিয়েছেন, তেমন কোনো দৃষ্টান্তও আমাদের হাতে নেই। যা হোক, সে আলোচনা যুক্তি-তর্ক এবং প্রমাণ সাপেক্ষ; তাই তর্কে না গিয়ে আমি বরং মাইকেল মধুসূদন দত্তে৬র নাট্যবিষয়ক আলোচনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখি।
॥২॥
মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’র আখ্যান গ্রহণ করা হয়েছে মহাভারতের আদিপর্ব থেকে। অবশ্য মধুসূদন তাঁর নাটকের প্রয়োজনে কাহিনীতে যথেষ্টই পরিবর্তন করেছেন। আমরা যদি তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র কথা স্মরণ করি,
সেখানেও দেখব, তিনি প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থাপন করেছেন রামায়ণের কাহিনীকে, রামায়ণের নবরূপায়ণ করেছেন মাইকেল মেঘনাধবধ কাব্যে। একই মধুসূদন পরিবর্তন করার স্পর্ধা দেখাবেন, সেটাই সঙ্গত। মহাভারতে যযাতির মধ্যে পূর্বরাগের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, কিন্তু শর্মিষ্ঠা প্রণয়াকাক্সক্ষী; কিন্তু শ্রী মধুসূদনের শর্মিষ্ঠায় বরং যযাতিই উপযাজক, যযাতিই শর্মিষ্ঠার প্রণয়প্রার্থী। শর্মিষ্ঠায় পাঠক বা দর্শক যেন কালিদাসের শকুন্তলার ছায়া দেখতে পান।
গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর ‘শর্মিষ্ঠা’র প্রচুর সফল মঞ্চায়নের বার্তা পাওয়া যায়; যদিও রামনারায়ণ তর্করতেœর মতো প্রাচীনপন্থি নাট্যবেত্তাগণ নাটকে প্রচুর সংস্কৃতশব্দের ব্যবহার সত্ত্বেও শর্মিষ্ঠার পক্ষে রায় দেননি। তারপরও শর্মিষ্ঠা সবার কাছে পরিত্যাজ্য হয়নি; তার প্রধান প্রমাণ বারবার এর সফল মঞ্চায়ন। সে সময় ব্রজেন্দ্রলাল মিত্র ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকায় শর্মিষ্ঠা নাটক সম্পর্কে লেখেন, “বাঙ্গালী নাট্যকারে ও দত্তজয়ে এই বিশেষ প্রভেদ যে পূর্ব্বোক্তেরা অভিনয়ে কি প্রকার বাক্যে কি প্রকার ফলোৎপত্তি হইবে তাহার বিবেচনা না করিয়া নাটক রচনা করেন; দত্তজ তাহার বিপরীতে অভিনয়ে কি প্রয়োজন, কি উপায়ে অভিনেয় বসবস্তু সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত হইবে; এবং কোন প্রণালীর অবলম্বনে নাটক দর্শকদিগের আশু হৃদয়গ্রাহী হইবেক ইহা বিশেষ বিবেচনা-পূর্ব্বক শর্মিষ্ঠা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তাহাতে প্রকৃত প্রস্তাবেরও কোন ব্যাঘাত ঘটে নাই।........” (মাঘ ১৭৮০ শকাব্দ, পৃষ্ঠা-২৪০)
আমরা যদি শর্মিষ্ঠা নাটকের সূচনা অংশ থেকে যদি সামান্য সংলাপ আমরা পড়ি, তাহলে সহজেই বুঝে যাব ব্রজেন্দ্রলাল মিত্রের বক্তব্য কতটা বস্তুনিষ্ঠÑ
দৈত্য: (স্বগত) আমি প্রতাপশালী দৈত্যরাজের আদেশানুসারে এই পর্ব্বতপ্রদেশে অনেক দিন অবধি ত বাস কচ্যি; দিবারাত্রের মধ্যে ক্ষণকালও স্বচ্ছন্দে থাকি না; কারণ ঐ দূরবর্ত্তী নগরে দেবতারা যে কখন্ কি করে, কখনই বা কে সেখান হত্যে রণসজ্জায় নির্গত হয়, তার সংবাদ অসুরপতির নিকটে তৎক্ষণাৎ লয়ে যেতে হয়। (পরিক্রমণ) আর এ উপত্যকাভূমি যে নিতান্ত অরমণীয় তাও নয়;Ñ স্থানে স্থানে তরুশাখায় নানা বিহঙ্গমগণ মধুর স্বরে গান কচ্যে; চতুর্দ্দিকে বিবিধ বনকুসুম বিকশিত; ঐ দূরস্থিত নগর হতে পারিজাত পুষ্পের সুগন্ধ সহকারে মৃদু মন্দ পবন সঞ্চার হচ্যে; আর কখন কখন মধুরকণ্ঠ অপ্সরীগণের তানলয়বিশুদ্ধ সঙ্গীতও কর্ণকুহর শীতল করে; কোথাও ভীষণ সিংহের নাদ, কোথাও ব্যাঘ্র মহিষাদির ভয়ঙ্কর শব্দ, আবার কোথাও বা পর্ব্বতনিঃসৃতা বেগবতী নদীর কুলকুল ধ্বনি হচ্যে। কি আশ্চর্য্য! এই স্থানের গুণে স্বজন বান্ধবের বিরহদুঃখও আমি প্রায় বিস্মৃত হয়েছি।
(পরিভ্রমণ) অহো! কার যেন পদশব্দ শ্রুতিগোচর হলো না! (চিন্তা করিয়া) তা এ ব্যক্তিটা শত্রু কি মিত্র, তাও ত অনুমান কত্যে পাচ্চি না; যা হোক, আমার রণসজ্জায় প্রস্তুত থাকা উচিত। (অসি চর্ম্ম গ্রহণ) বোধ হয়, এ কোন সামান্য ব্যক্তি না হবে। উঃ! এর পদভরে পৃথিবী যেন কম্পমানা হচ্যেন। (প্রথম গর্ভাঙ্ক: হিমালয় পর্ব্বতÑদূরে ইন্দ্রপুরী অমরাবতী ॥ শর্মিষ্ঠা)
‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে মাইকেল মধুসূদন দত্ত দুটি প্রহসন রচনা করে তাঁর সূক্ষè দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ সচেতনতা এবং রসবোধ সম্পর্কে আমাদের নাড়া দিয়েছেন তুমুলভাবে। ইয়ং বেঙ্গলের জীবনাদর্শ আর জীবনাচারের সুতীক্ষè কটাক্ষ হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি তাঁর ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ নামের প্রহসনকে। তারুণ্যের অনাচার, উশৃঙ্খলতাকে সমালোচনা করলেও শ্রী মধুসূদন জরাগ্রস্ত-পশ্চাৎপদ-স্থবির, বার্ধক্যকে দিশা বলে চিহ্নিত করেননি; তাই দেখি প্রাচীনপন্থি ‘বাবাজী’ চরিত্রের অন্তঃসারশূন্যতাকে তিনি অনুকরণীয় না বলে, বরং সে চরিত্রের মনুষত্বহীনতাকেই ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট থেকেছেন।
আর ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে তো শ্রী মধুসূদন প্রাচীনপন্থিদের অন্তঃসারশূন্যতাকেই উপজীব্য করেছেন। একজন কপটধার্মিক বৃদ্ধ জমিদারের সীমাহীন লাম্পট্য, কলুষিত জীবন এবং পরিণতিতে অপরাধীর সম্মান-বিনষ্টিই এ প্রহসনের বিষয়। মধুসূদন দত্তের প্রহসন দুটির সংলাপ, উপস্থাপনকলা, ঘটনা-পরম্পরার বিন্যাসশৈলী নাট্যকারের দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিচয় করিয়ে দেয় পাঠক-দর্শকের সঙ্গে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেন, “এই দুইখানা গ্রন্থ বাঙ্গালা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাট্য রচনার অন্যতম।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৬৪)।
পদ্মাবতী নাটকের আশ্রয় নারীর সৌন্দর্য বিষয়ক ঈর্ষা। গ্রিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও পদ্মাবতী নাটকে শ্রী মধুসূদন ভারতীয় পুরাণ এবং সমাজ-আবহ সমন্বয় করেছেন নিপুণভাবে। গ্রিক পুরাণে ‘ডিসকর্ডিয়া’ বা কলহদেবী অন্য দেবীরা যেন বিবাদে লিপ্ত হন, সে উদ্দেশ্যে একটি আপেল নিক্ষেপ করেন এবং বলেন, “এটি শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য। জুপিটারপতœী জুনো, জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী প্যালাস এবং সৌন্দর্য ও প্রেমের দেবী ভেনাস; সবাই আপেলটি পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অতঃপর ট্রয় রাজপুত্র প্যারিসকে তারা মধ্যস্থতা মেনে তার হাতেই আপেলটি তুলে দেন; প্যারিস সর্বাধিক সুন্দরী হিসেবে ভেনাসকে আপেলটি হস্তান্তর করেন।
জুনো আর প্যালাস ঈর্ষান্বিত হন, ক্ষুব্ধ হয়ে তারা প্যারিসের ক্ষতিসাধনে ব্রতী হন। এটাই ছিলো ট্রয় নগরী ধ্বংসের নেপথ্যকারণ। পদ্মাবতী নাটকের শচী, রতিদেব, নারদ, রাজা ইন্দ্রনীল এবং রাজকুমারী পদ্মাবতী চরিত্রগুলো যথাক্রমে গ্রিকপুরাণের জুনো, ভেনাস, ডিসকর্ডিয়া, প্যারিস এবং হেলেনের আদর্শে রচিত। গ্রিকপুরাণের জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী প্যালাসের স্থলে পদ্মাবতী নাটকে যক্ষরাজমহিষী মুরজা দেবীকে সংস্থাপন করেন। হয়তবা মধুসূদন জ্ঞান ও বিদ্যার দেবীকে বিবাদ পরায়ণা করতে চাননি; নারীর বহিরাঙ্গের সৌন্দর্যের চেয়ে আত্মার সৌন্দর্যকে বড় করে তুলে মাইকেল সুরুচির পরিচয়ই দিয়েছেন, এবং এখানেই শ্রী মধুসূদনের স্বাতন্ত্র্য।
পদ্মাবতী নাটকেই মাইকেল প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ করেন। নাটকটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমভাগে প্রথম প্রকাশিত হয়। পদ্মাবতী নাটক সম্পর্কে শ্রী সুকুমার সেন বলেন, “পদ্মাবতীর কাহিনীতে ‘রূপকথার প্রভাব অস্পষ্ট নয়’ এবং নাট্য পরিকল্পনায় সংস্কৃত নাটকের আদর্শ গৃহীত হয়েছে। কোন কোন ঘটনা বিন্যাসে ‘শকুন্তলা ও বিক্রমোর্ব্বশীয়’ নাটকের প্রভাব বর্তমান।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৫৬)।
ধারণা করা হয় ১৭৭৯ শকাব্দের পৌষ সংখ্যা ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এ প্রকাশিত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ ‘কৃষ্ণকুমারীর ইতিহাস’ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েই শ্রী মধুসূদন ১৮৬০-এর আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে রচনা করেন ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকটি। নাটকটি প্রথম ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার নাট্যশালায় অভিনীত হয়। সে সময় ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেন, “গত শুক্রবার রাত্রিতে শোভাবাজারের সখের থিয়েটারের দল সম্ভ্রান্ত ও সুনির্ব্বাচিত দর্শকদের সমক্ষে, বাবু মাইকেল মধুসূদন দত্ত-প্রণীত সুপরিচিত বিয়োগান্ত ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের প্রথম প্রকাশ্য অভিনয় দেখাইয়া সকলকে আনন্দিত করেন।
‘কৃষ্ণকুমারী’ বাংলা ভাষায় সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র মৌলিক নাটক।” কৃষ্ণকুমারী নাটক প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেন, “ইতিহাস-কাহিনী নির্ভর বাঙ্গালায় প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি” (পৃষ্ঠা-৫৯) অথবা “কৃষ্ণকুমারীর ভাগ্যচক্র গ্রীক ট্র্যাজেডির অপরিহার্য নিয়তির মত সমগ্র নাটকটির উপর ছায়াপাত করিয়াছে। প্রউবিপিদেস-এর ইফিগেনিয়া (ওঢ়যরমবহবরধ ব বহ অঁষরফর) নাটকের ক্ষীণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কৃষ্ণকুমারীর বলিদানে। (পৃষ্ঠা-৫৯)। নাট্যকার মুনীর চৌধুরী অবশ্য তাঁর ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেন, “কৃষ্ণকুমারীতে শেক্সপিয়রের প্রভাবই প্রত্যক্ষ।” (আহমদ পাবলিশিং হাউস, পৃষ্ঠা-২২৭-২৪৯)।
গুণিজনের উপরোক্ত মন্তব্য প্রসঙ্গে আমি নিজস্ব কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি; কিন্তু এ কথা অবশ্যই বলব, শ্রী মধুসূদন ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে যতটা অভিনিবেশন ও যতœ নিয়ে বিভিন্ন চরিত্রসৃজনে মনোনিবেশ করেছিলেন, তা এক কথায় অসাধারণ। যে কথা জীবনানন্দ দাশ বহু বছর পর উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায়, সেই একই কথা শ্রী মধুসূদন উচ্চারণ করেছেন বহু বছর আগে তাঁর কৃষ্ণকুমারী নাটকে। নাটকের একটিমাত্র সংলাপের অংশবিশেষ উদ্ধার করছিÑ
ধনদাস: (স্বগত) এখন তোমার যেখানে ইচ্ছা, গমন কর। আমার যা কর্ম্ম তা হয়েছে। (পরিক্রমণ) ধনদাস বড় সামান্য পাত্র নন্। কোথায় উদয়পুরের একজন বণিকের চিত্রপট কৌশলক্রমে প্রায় বিনা মূল্যেই হস্তগত করা হলো; আবার তাই রাজ্যকে বিক্রয় করে বিলক্ষণ অর্থ সংগ্রহ করলেম ! একি সামান্য বুদ্ধির কর্ম্ম ! হা ! হা ! হা ! বিশ সহ¯্র মুদ্রা ! হা ! হা ! হা ! মধ্যে থেকে আবার এই অঙ্গুরিটিও লাভ হয়ে গেল ! .... এ কালে কি নিতান্ত সরল হলে কাজ চলে ! কখন বা লোকের মিথ্যা গুণ গাইতে হয়, কখন বা অহেতু দোষারোপ কত্যে হয়; কারো বা দুটো অসত্য কথায় মনঃ রাখতে হয় আর করু কারু মধ্যে বা বিবাদ বাধিয়ে দিতে হয়; এই তো সংসারের নিয়ম।
অর্থাৎ, যেমন করে হোক আপনার কার্য্য উদ্ধার করা চাই। তা না করে, যে আপনার মনের কথা ব্যক্ত করে ফেলে, সেটা কি মানুষ ? হুঁ ! তার মন তো বেশ্যার দ্বার বল্যেই হয় ! কোন আবরণ নাই। যার ইচ্ছা সেই প্রবেশ কত্যে পারে। এরূপ লোকের ত ইহকালে অন্ন মেলা ভার আর পরকালেÑপরকাল কি ? পরকালে বাপ নির্ব্বংশÑআর কি ! হা ! হা ! যাই, অগ্রে ত টাকাগলো হাত করিগে; পরে একবার মন্ত্রীর কাছে যেতে হবে। আঃ, সেটা আবার এক বিষম কণ্টক ! ভাল, দেখা যাক মন্ত্রীভায়ার কত বুদ্ধি ! (প্রস্থান) (প্রথমাঙ্ক ॥ প্রথম গর্ভাঙ্ক ॥ কৃষ্ণকুমারী নাটক)
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর জীবনের শেষ ভাগে রোগশয্যায় রচনা করেন শেষ নাটক ‘মায়াকানন’। মায়াকানন রচিত হয় ১৮৭৩-এর মধ্যভাগে।
প্রথম মঞ্চায়ন এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর ১৮৭৪-এর এপ্রিল ও মার্চে। প্রথম সংস্করণে গ্রন্থের প্রকাশকদ্বয় লিখেন, “বঙ্গরঙ্গভূমিতে অভিনীত হইবার উদ্দেশে আমরাই তাঁহাকে দুইখানি উৎকৃষ্ট নাটক প্রণয়ন করিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম। তদানুসারে তিনি ‘মায়াকানন’ নামে এই নাটক ও ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ নামে আরেকখানি নাটকের কতক অংশ রচনা করেন। লেখা সমাপ্ত হইবার অগ্রে তাঁহাকে উপযুক্ত মূল্য দিয়া এবং পীড়াকালীন সাহায্য দান করিয়া আমরা উভয়ে ঐ দুই নাটকেরও অধিকারিত্ব স্বত্ব ও বঙ্গরঙ্গভূমে অভিনয়ের অধিকার ক্রয় করিয়াছি।...
মায়াকানন বিয়োগান্ত নাটক। ইহার অন্তর্গত করুণ রস পাঠ করিয়া কোন ক্রমে অশ্রু সম্বরণ করা যায় না।......
শ্রী শরচ্চন্দ্র ঘোষ
শ্রী অখিলনাথ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক।”
সুকুমার সেন বলেন, “কৃষ্ণকুমারীর মত মায়াকানন-ও বিয়োগান্ত নাটক। তবে কৃষ্ণকুমারী আশাদীপ্ত কল্পনার সৃষ্টি, এবং কৃষ্ণকুমারীর আত্মোৎসর্গ পরম করুণ। তাহার চিন্তায় হতাশার দৈন্য ও অসহায়তা নাই। মায়াকাননের ট্র্যাজেডি নিষ্করুণ শোকাবহ, এবং মধুসূদনের জীবনে যেমন এখানেও তেমনি নায়ক-নায়িকার সব আশা ভরসা নিঃশেষে চুকিয়া গিয়া তবে যবনিকা পতন হইয়াছে।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৬১)। যশোরের কপোতাক্ষ তীরের কবি-নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকের মতোই এক বর্ণময় জীবন যাপন করে যান; নাটকীয়তায় পূর্ণ তাঁর প্রয়াণও। কবিতার মতোই গভীর আর হৃদয়স্পর্শী জীবনের শেষভাগে রোগশয্যায় শুয়েও তাঁকে অর্থ প্রাপ্তির জন্য নাটক রচনায় মনোনিবেশ করতে হয়; এবং এক ট্র্যাজিক নাটকের নায়কের মতোই দুঃখীজীবনের সমাপ্তি টানেন।
যার যৌবনে যথেচ্ছ অর্থ ব্যয়ের জন্য তিনি অমিতব্যয়ী বলে সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন, জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। সেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনোপলব্ধি আর পরিপার্শ্ব পাঠের অভিজ্ঞতাই তাঁর নাট্যরচনা; বিশেষ করে মায়াকানন। কবিতায় যেমন শ্রী মধুসূদন আধুনিকতার উদ্গাতা, নাটকেও মধুসূদন সমান প্রাগ্রসর; তাঁর নাটকসমূহ পাঠ করে তাঁকে বাংলা নাটকের সূচনাপর্বের নাট্যশ্রী অভিধায় সম্মান জানাতে তাই দ্বিধা থাকে না পাঠকের অন্তরে। নাট্যশ্রী শ্রী মধুসূদনকে একজন নাট্যকর্মী হিসেবে কুর্নিশের মাধ্যমে সম্মান জানিয়ে নিজেকেই সম্মানিত করতে চাই।
লেখক : কবি ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার-২০২২ প্রাপ্ত নাট্যকার