ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

সরকার মাসুদ

বৈশাখী মেলা ছেলেবেলার স্মৃতি

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ১৪ এপ্রিল ২০২২

বৈশাখী মেলা ছেলেবেলার স্মৃতি

ক্লাস সিক্সে বা সেভেনে পড়ার সময় আমি প্রথম বৈশাখী মেলায় যাই। ছোট দাদা মনিরউদ্দিন সরকারের হাত ধরে মেলা দেখতে যেতাম। মনিরউদ্দিন ছিলেন ফুর্তিবাজ মানুষ। গান-বাজনা ভালবাসতেন। যাত্রা-জারি এসব দেখতেন। আবার নামাজ-কালামও পড়তেন। পিতার চাকরি সূত্রে আমি বেড়ে উঠেছি রংপুর শহরে। মেলার সময়টায় দাদাবাড়ি চলে যেতাম- নতুন অনন্তপুরে। এটা কুড়িগ্রাম জেলার একটা গ্রাম। সত্তরের দশকে ওখানে রিকশা চলত না। মাটির রাস্তাগুলো ছিল ধুলায় ভরা। আর ছিল গরুর গাড়ি। মোষের গাড়িও দেখা যেত। ওই সময় আমার দাদাবাড়ি থেকে তিন/চার মাইলের ভেতর অনেকগুলো মেলা বসত। মেলা বসত চৈত্র সংক্রান্তিতেও। কোন কোনটি বৈশাখের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে হতো। আবার মাসব্যাপী মেলাও ছিল। এসবের মধ্যে তিনটা মেলার কথা খুব মনে পড়ে। হাতিয়ার মেলা, সিদ্ধেশ্বরীর মেলা ও জানজাগিরের মেলা। আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছে জানজাগির। বড়জোর দুই কিলোমিটার দূরে। ছোট মেলা, কিন্তু এর বড় আকর্ষণ ছিল লাঠিখেলা। দূর-দূরান্ত থেকে লাঠিয়ালরা এসে যোগ দিতেন। মেলা বসত দুপুরের পর। এই মেলাটায় আমি গিয়েছিলাম আলতাফ চাচার (মনিরউদ্দিনের ছেলে) সঙ্গে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মোয়া চিবাচ্ছি আর খেলা দেখছি। অসংখ্য মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। যারা বেশ লম্বা তারা অন্য মানুষের মাথার ওপর দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় দু’জন লাঠিয়াল। তারা হম্বিতম্বি করছে। একজন বেশ হালকা-পাতলা এবং খাটো। অন্যজন প্রায় দৈত্যের মতো। হালকা-পাতলা লোকটির ভাব-ভঙ্গি কিন্তু দেখার মতো। লাঠিও ঘোরাতে পারে ভাল। দৈত্যের তেমন ভঙ্গি নেই তবে কৌশল আছে, যদিও লাঠি তার হাতে বেশি ঘোরে না। লম্বা লাঠির অন্য প্রান্ত অনেকক্ষণ মাটিতে ছেঁচড়ে এনে ‘হু-ই-ই-ই’ শব্দ করে ঘুরে গেল পাতলা লোকটি। সেই লাঠি দৈত্যের পিঠে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে পাতলা লাঠিয়ালের পাছায় আঘাত করল দৈত্যের বাঁশ। হৈ হৈ করে উঠল লোকজন। একটু পরে পাতলা লাঠিয়ালের মুখে আবার সেই ‘হু-ই-ই-ই’ এবং তার লাঠি ঘুরে আসার আগেই তারই পিঠে দৈত্যের লাঠির আঘাত। সশব্দে হেসে উঠেছে জনতা। লাঠি খেলা এখন পরিণত হয়েছে জমজমাট কৌতুকে। জানজাগির গ্রামের মেলার কথা মনে পড়লেই সবার আগে আমার চোখে ভাসে ওই দৃশ্যটি। হাতিয়ার মেলা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মেলা। তিন/চার দিন ধরে চলে। উলিপুর থানার হাতিয়া ইউনিয়ন ব্রহ্মপুত্রের কাছাকাছি। ইউনিয়নের নামেই মেলার নামকরণ হয়েছে। থানা সদর থেকে সাত মাইল দূরে হাতিয়া। এই মেলায় ঘোড়ার দৌড় হতো। শুধু এই ঘোড়দৌড় দেখার জন্যই জড়ো হতো হাজারখানেক মানুষ। আমুদে জনতা সঙ্গে আনত বেলুন, ব্যানার, লম্বা লেজযুক্ত পতাকা। রীতিমতো উৎসব আর কি! বেলা আড়াইটা/তিনটা নাগাদ মেলা পরিণত হতো জনসমুদ্রে। বিকেল পাঁচটার পর কমতে থাকত মানুষ। দোকানগুলো খোলা থাকত মধ্যরাত পর্যন্ত। রাত ন’টার পর ওখানে থাকত প্রধানত জুয়াড়িরা। ঘোড়দৌড়টা খুব ভাল লাগত আমার। বাঁশ+কাগজ দিয়ে তৈরি ঘোড়া, উট, মিনার নিয়ে আসত গ্রামের মানুষ। এগুলো নিয়ে শোভাযাত্রাও হতো। তখন ওই ঘোড়া, উট, মিনার বহনকারী লোকদের পেছন পেছন হাঁটত জনতা। তারা দলবেঁধে ঘুরে আসত গোটা মেলা প্রাঙ্গণ। এ ছবিটা আমার মাথায় সেটে আছে আজও। ষাটোর্ধ্ব মানুষেরা ভিড় বেশি হওয়ার আগেই মেলা থেকে ফিরে আসতে চাইত। সে জন্য তারা রওনা দিত সকাল সকাল। যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটত তারা। তার পরও কেউ কেউ পিছিয়ে পড়লে এগিয়ে থাকা লোকরা বলত, হাঁটো বাহে; বেলা হবার নাগছে! রাস্তা শর্টকাট করার জন্য মানুষ সড়ক ধরে না গিয়ে জমির মাঝখানের হাঁটাপথ ধরে এগোতো। তবু পথ ফুরাতে চায় না। সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়ত বৃদ্ধা ও শিশুরা। তারা হাঁটতে হাঁটতে কুলাতে না পেরে একসময় দাঁড়িয়ে পড়ত। কেউ কেউ বসে পড়ত আলোর ওপর। ছোটরা প্রথমদিকে হেঁটে-দৌড়ে এগোতে থাকলেও আধাঘণ্টা পর ঝিমিয়ে যেত। তখন বড়দের মধ্য থেকে কেউ মুখ ঝামটা দিয়ে বলে বসত, এহ! হাঁটপার মুরাদ নাই, মেলা দেখার শখ কত! ফির আসপু? ক! আসপু ফির? বাচ্চাদের তখন প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সিদ্ধেশ্বরী মেলার কথা। আমজনতা বলে ‘ঠাকুরবাড়ির মেলা।’ ওখানে অনেকবার যাওয়া হয়েছে আমার। মেলা প্রাঙ্গণ নানাবাড়ির খুব কাছে। সেটা একটা কারণ। অন্য কারণ হচ্ছে মেলাটা এক মাস ধরে চলে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার, হাটের মতো। উলিপুর-বাগুয়া অনন্তপুর সড়কের মাঝামাঝি একটা জায়গায় আরেকটা রাস্তা ঢুকে গেছে ধামশ্রেণীর দিকে। ওই পথ ধরে আধাঘণ্টা হাঁটলেই আপনি পেয়ে যাবেন ঠাকুরবাড়ি। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য সোনালু গাছ। বিরাট আকৃতির লম্বা লম্বা দুলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ হলুদ ফুল ঝুলে থাকে। যতদূর চোখ যায় ওই গুচ্ছফুলের অনিঃশেষ সারি যেন গাছের ডালে নয় ঝুলে আছে পল্লীবালাদের লজ্জা শিহরিত কানের লতিতে লতিতে।চড়ক গাছ আমি প্রথম দেখি সিদ্ধেশ্বরী মেলায়। পিঠে চামড়ার বিশাল বড়শি বাঁধা ঝুলন্ত একজন মানুষ চারদিকে ঘুরছে ধীরে ধীরেÑ এ দৃশ্য কোনদিন ভুলবার নয়। অসংখ্য মানুষের মাঝখানে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা আমার কিশোর মন সেদিন বার বার বলে উঠেছিল, কী করে সম্ভব! কী করে সম্ভব! মেলা প্রাঙ্গণে ঢোকার একটু আগে গোঁসাই বা গানটা চোখে পড়তই। নানা গাছ-গাছালি ভরা, অন্ধকার-অন্ধকার সেই বড় বাগান দেখে আমার ভয়-ভয় করত। হাজারীদের পুকুরপাড়ে ফুটে থাকত থোকা থোকা ভাঁটফুল, আ! জীবনানন্দের ভাটফুল! এই মেলার আরেকটা আকর্ষণ ছিল জুয়াখেলা। হাতিয়ার মেলায় জুয়া বসত সন্ধ্যার পর। এখানে তা চলত সারা দিন। ছোট থাকতে যেতাম হবিবুর মামার সঙ্গে। মেলায় ঢুকেই হবি মামা আমাকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। জিলাপি ও নানা রকম রসগোল্লা, খাজা-গজার ডালা সাজিয়ে বসে থাকত দোকানিরা। আমার পছন্দ ছিল পাতলা সিরার সাদা মিষ্টি, এখন যেটাকে বলে ‘স্পঞ্জ রসগোল্লা’। তারপর হাঁটতে হাঁটতে মামা আমাকে নিয়ে হাজির হতেন সেই স্থানে যেখানে জুয়াড়িদের আড্ডা। ছক্কা জুয়াটা বেশ মজার। লুডোর ছক্কার মতো দেখতে বৃহৎ একটা ছক্কার দান দেয়া হতো পাতলা টায়ার দিয়ে তৈরি মগে করে। ওই মগের ভেতর ছক্কাটা ঘুরিয়ে যখন চাদরের ওপর ঢালা হতো, সেই মুহূর্তে ‘গাবাউ’ করে শব্দ হতো একটা! অদ্ভুত শব্দটা এখনও শুনতে পাই আমি। আরেক ধরনের জুয়ার কথা মনে পড়ে। পানির ওপর মাঝারি সাইজের কয়েকটা টিনের থালা ভাসছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ওই প্লেটগুলোর ওপর কয়েন ফেলতে হবে। আট আনার কয়েন। মনে হবে কাজটা খুব সোজা। কিন্তু পয়সা থালায় পড়ামাত্র লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে যায়। পানিতে পড়ে গেলে লোকসান। আর প্লেটের ওপর থাকলে দ্বিগুণ পয়সা পাবে নিক্ষেপকারী। দেখা গেল, প্রতি পাঁচ/সাতজন লোকের মধ্যে সফল হচ্ছে এক/দু’জন। হবি মামা এই খেলাটা খুব পছন্দ করতেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছয়/সাত বার খেলে ছিলেনও। লাভ করতে পারেননি। একবার কেবল মূলটা কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দশ টাকা। তাতেই তিনি মহাখুশি। আমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলেন আসর থেকে। সিদ্ধেশ্বরী মেলা প্রধানত হিন্দুদের মেলা। কিন্তু শত শত মুসলমানও তাতে যোগ দিত। উৎসবটা তারাও কম উপভোগ করত না। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও আসত দলবেঁধে। তারা শুধু মিঠাই মা-া নয়, নানা ধরনের নানা আকৃতির মাটির পুতুল, তৈজসপত্র ইত্যাদি কিনত। মনে আছে আমি একবার ওই মেলা থেকে কিনেছিলাম একটা মাটির তৈরি রবীন্দ্রনাথ। পুতুল রবীন্দ্রনাথের গলাটা স্প্রিঙ দিয়ে কায়দা করে দেহের সঙ্গে লাগানো ছিল। আঙ্গুল দিয়ে একটু নাড়া দিলেই অনেকক্ষণ ধরে মাথা ঝাঁকাত। রংপুর শহরের কালেক্টরেট ময়দানে, স্কুলে পড়ি তখন, মহররমের মেলা হতো। সেখানেও দেখেছি, মুসলমানদের পাশাপাশি অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ভিড় কম ছিল না। তা সত্ত্বেও মেলায় আগত যুবকরা ভিড়ের সুযোগ নিয়ে তরুণীদের গায়ে হাত দিত না। এখন এই কুকর্মটি অনেকেই করে ফেলে অবলীলায়। সে যুগে এটা করার কথা ভাবতেই পারত না ছেলেরা। তারা বড়জোর ‘কী দিদিই, আলতা কিনবে না?’ অথবা ‘একা নাকি! ’র মতো দু’-একটা সরস মন্তব্য করত। গ্রাম-বাংলায় বিনোদন বলতে আজ আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। পনেরো/বিশ বছর আগেও কিছু কিছু ছিল। নানা উপলক্ষে মেলা, যাত্রা, পুতুলনাচ এসব হতো। এখন তো যাত্রার প্যান্ডেল চোখেই পড়ে না। যাও দু’-একটা দেখা যায় তা নদীর পাড়ে কিংবা জনপদের এক প্রান্তেÑ অতটাই অবহেলিত হয়ে গেছে। আজ বৈশাখী মেলা গ্রাম থেকে উঠে এসেছে শহরের উদ্যানে ও রাজপথে। ফলে সে তার আদি-আসল চেহারা হারিয়ে ফেলেছে। কাক ধারণ করেছে ময়ূর পুচ্ছ! ২০১৬ সালে শেষবার গিয়েছিলাম সিদ্ধেশ্বরী মেলায়। মনটা হু হু করে উঠলো বেদনায়। শ’তিনেক মানুষও বোধ হয়ছিল না। অথচ দেশের জনসংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। পরে ভাবলাম, মানুষ মেলায় আসবে কি করে? মান ও জান হারানোর ভয়ে তারা সিটিয়ে আছে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছে। তাদের ‘সৈনিক’রা একাধিক সমাবেশে বোমা ফাটিয়েছে। আগেও আমরা মুসলমান ছিলাম। বাঙালী তো ছিলামই। এখনও তা-ই আছি। আগে ছিল সৌহার্দ-ভ্রাতৃত্ব, শান্তি। এখন হিন্দু, খ্রীস্টান, বৌদ্ধরা আর আমাদের ভাই নয়! আজ আমরা বড় বেশি ‘মুসলমান’ হয়ে গেছি। আজ মেলা নেই, মিলামিশ নেই, ভালবাসা নেই। সব ধরনের বাড়াবাড়ি এবং হত্যার রাজনীতি যে কোন ধর্মেই নিষিদ্ধ, এটা ভুলে গেছে মানুষ!
×