
ছবি: সংগৃহীত
কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলের গভীর সমুদ্রের নিচে প্রায় তিনশো বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা এক স্প্যানিশ যুদ্ধজাহাজ—যা বহুমূল্য সোনা, রূপা ও রত্নভাণ্ডারে পরিপূর্ণ—তার অস্তিত্বের আরও অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। বিজ্ঞানীরা এবার পানির নিচে ডুবোযান পাঠিয়ে সেই জাহাজের অভ্যন্তরের নতুন ছবি তুলেছেন এবং তাতে ফুটে উঠেছে স্পেনের রাজমুকুট ও জেরুজালেম ক্রস খচিত সোনার মুদ্রার নিখুঁত বিবরণ।
সম্প্রতি Antiquity জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, এ মুদ্রাগুলো ১৭০৭ সালে লিমা, পেরুতে টাকশালে তৈরি হয়েছিল এবং এই আবিষ্কার নিশ্চিত করে যে এই জাহাজডুবির ঘটনা তার পরেই ঘটেছিল।
সত্যিই কি এটি ‘সান হোসে’?
গবেষকেরা বিশ্বাস করছেন, এই জাহাজটি হলো সেই বিখ্যাত San José Galleon—স্পেনের রাজকীয় ‘ফ্লোটা দে তিয়েরা ফার্মে’ বহরের একটি অংশ, যা ১৭০৭ সালে পেরু থেকে যাত্রা করলেও ১৭০৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে ক্যারিবীয় সাগরে ডুবে যায়।
কলম্বিয়ার জাতীয় ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব সংস্থার (ICANH) প্রধান গবেষক ড্যানিয়েলা ভার্গাস আরিজা বলেন, ‘এই ধ্বংসাবশেষে পাওয়া মুদ্রাগুলো আমাদের এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে—সমুদ্রতলে একটি প্রাচীন অর্থনৈতিক রুট ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে বোঝার।’ তিনি জানান, “হাতে গড়া অনিয়মিত আকারের এই ‘কব’ মুদ্রা (স্প্যানিশে ‘মাকুইনা’) আমেরিকায় দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হত।”
সত্যি কী পরিমাণ ধনসম্পদ আছে সান হোসেতে?
ধারণা করা হয়, সান হোসে গ্যালিওন জাহাজটি প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের সোনা, রূপা ও মূল্যবান বস্তু বহন করছিল—যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান জাহাজডুবির ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছে।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জাহাজডুবি নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। কলম্বিয়া সরকার ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সহায়তায় প্রথম এটির অবস্থান শনাক্ত করার দাবি করলেও, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামুদ্রিক উদ্ধার কোম্পানি Sea Search-Armada (SSA) (পূর্বে Glocca Morra নামে পরিচিত) দাবি করেছে, তারা ১৯৮০-এর দশকেই জাহাজটি আবিষ্কার করেছিল। SSA বর্তমানে Permanent Court of Arbitration-এ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা চালাচ্ছে।
মুদ্রার ছবি ও প্রতীক বলছে বহু কথা
গবেষকদের তোলা ছবিতে দেখা গেছে—সোনার মুদ্রাগুলোতে স্পেনের ক্যাস্তিল ও লেয়নের রাজমুকুটের প্রতীক এবং ‘জেরুজালেম ক্রস’ খচিত। প্রতিটি মুদ্রা তিন মাত্রিক স্ক্যান করে ‘ফোটোগ্রামেট্রি’ পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পানির নিচে থাকা বস্তু বিশদভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব।
জাহাজবিষয়ক প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষণা দলের সদস্য জেসুস আলবার্তো আলদানা মেন্ডোজা বলেন, ‘এত গভীর সমুদ্রে এমন স্পষ্টভাবে এই রকম প্রত্নবস্তু পাওয়াটা অভাবনীয়। এই প্রকল্প ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বকে একসঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে।’
যুদ্ধ, ধনসম্পদ, আর ইতিহাসের টানাপড়েন
‘সান হোসে’কে অনেকেই ‘হলি গ্রেইল অফ শিপরেকস’ বলেন, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজকীয় ধনভাণ্ডার, ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও আধিপত্য বিস্তারের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। একদিকে এটি ১৮শ শতাব্দীর সামুদ্রিক বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, অন্যদিকে এটি এখন আন্তর্জাতিক সম্পদ নিয়ে আইনগত দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে।
যখন জাহাজটি ১৭০৮ সালে কলম্বিয়ার কার্তাহেনা উপকূলে ডুবে যায়, তখন তা ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণা ও প্রত্নতত্ত্ব মিলে আজ সেই ইতিহাস আবার জেগে উঠছে। আর প্রতিটি মুদ্রা যেন একটি করে বার্তা—যা বলছে, সমুদ্র শুধু জলরাশি নয়, বরং তা সময়ের সিন্দুক, যেখানে লুকিয়ে আছে রাজ্য, যুদ্ধ আর ঐশ্বর্যের গল্প।
সূত্র: সিএনএন।
রাকিব