
প্রাচীন চীনের এক গোপন নক্ষত্র তালিকা, যেটি দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ইতিহাসের আড়ালে ছিল, সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। ‘স্টার ম্যানুয়াল অব মাস্টার শি’ নামে পরিচিত এই পান্ডুলিপি বিশ্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চীনের জাতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (NAO) এই তালিকাকে এখন বিশ্বের প্রাচীনতম টিকে থাকা নক্ষত্র তালিকা হিসেবে দাবি করছে।দুই সহস্রাব্দ ধরে লুকিয়ে থাকা ‘স্টার ম্যানুয়াল অব মাস্টার শি’ নতুন আলো ফেলছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উৎপত্তির উপর।
চীনের আকাশে রাজদরবারের প্রতিচ্ছবি
এই তালিকাটি প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৫ সালের বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা প্রাচীন গ্রিক বা অন্যান্য পরিচিত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক তালিকার চেয়েও শত শত বছর পুরনো। এতে এমন সব নক্ষত্রমণ্ডল চিত্রিত হয়েছে যা এক ধরনের ‘আকাশীয় রাজদরবার’ গঠন করে—সম্রাটের রথ, আকাশে বাজার কিংবা এমনকি একটি টয়লেট ও মল প্রতীকও রয়েছে।
এই প্রতীকগুলো ইঙ্গিত করে যে তৎকালীন চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশের নক্ষত্রসমূহকে ভূ-পৃষ্ঠের রাজকীয় গঠন অনুযায়ী সাজিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা দিতেন। রাজসভায় নিয়োজিত জ্যোতিষীরা এই তথ্যের ভিত্তিতে সম্রাটের ভাগ্য ও শাসনের বৈধতা নির্ধারণে সহায়তা করতেন। এতে করে আকাশের ঘটনাবলিকে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জড়িয়ে দেখা হতো।
জটিল বিশ্লেষণে উঠে এল দুই স্তরের নির্মাণকাল
NAO-এর গবেষক বো লিয়াং হে ও ইয়োংহেং ঝাও একটি অত্যাধুনিক অ্যালগরিদমের মাধ্যমে পান্ডুলিপিটির তারামণ্ডল বিশ্লেষণ করেন। এতে ব্যবহৃত হয় জেনারেলাইজড হাফ ট্রান্সফর্ম নামক এক ইমেজ প্রসেসিং প্রযুক্তি। এই অ্যালগরিদমের মাধ্যমে তারা দুর্বল বা বিকৃত তারার অবস্থান বাদ দিয়ে উত্তর মেরুর ঐতিহাসিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে পান্ডুলিপিটির সময়কাল নির্ধারণ করেন।
তাদের বিশ্লেষণ বলছে, তালিকার প্রায় অর্ধেক তারার অবস্থান খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৫ সালের, অর্থাৎ যুদ্ধরত রাজ্য যুগের বিখ্যাত জ্যোতিষী শি শেন-এর সময়ের। অন্য অর্ধেক তারার তথ্য খ্রিস্টীয় ১২৫ সালের দিকে হালনাগাদ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যা ছিল পূর্ব হান রাজবংশের সময়। তখন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ঝাং হেং আর্মিলারি স্ফিয়ার উদ্ভাবন করেন এবং দুই দফা রাজজ্যোতিষীর দায়িত্ব পালন করেন।
এই দ্বিস্তরীয় নির্মাণশৈলীই আগের গবেষণায় পাওয়া তারার অবস্থানগত অসামঞ্জস্যের ব্যাখ্যা দেয়।
তবে এই পান্ডুলিপির সময়কাল নিয়ে বিতর্ক একেবারে থেমে যায়নি। ইতিহাসবিদ বোশুন ইয়াং যুক্তি দিয়েছেন, পান্ডুলিপিতে ব্যবহৃত যন্ত্রের ভুল অক্ষাংশ নির্দেশের কারণে কিছু তারার অবস্থান প্রকৃত মেরু বিন্দুর চেয়ে প্রায় এক ডিগ্রি সরে যেতে পারে, যার ফলে সময়কাল নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
ইয়াং ও অন্য গবেষকরা মনে করেন, তালিকাটির গোলাকার স্থানাঙ্ক পদ্ধতি প্রথম শতকের খ্রিস্টপূর্ব যুগের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, তখন চীনে প্রথমবারের মতো আর্মিলারি স্ফিয়ার এবং গোলাকার মহাবিশ্বের ধারণা গৃহীত হয়েছিল। এটি ছিল এক যুগান্তকারী পালাবদল, যেখানে আগের সমতল মহাবিশ্বের ধ্যানধারণা সরিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ শুরু হয়।
ফ্রান্সের সেন্টার ফর রিসার্চ অন ইস্ট এশিয়ান সিভিলাইজেশনসের ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল প্যাট্রিক মর্গান এই তারিখ নিয়ে তুলনা করে বলেন, “এটি যেন ১৭০০ সালের একটি পেট্রোল পাম্পের রসিদ খুঁজে পাওয়ার মতো।” অর্থাৎ, এটি ইতিহাসের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত
যদি গবেষকদের সময়কাল নির্ধারণ সঠিক প্রমাণিত হয়, তবে এই তালিকাটি গ্রিক জ্যোতির্বিদ হিপারকাসের (খ্রিস্টপূর্ব ১৩০) তৈরি নক্ষত্র তালিকার চেয়েও পুরনো হবে। যদিও ব্যাবিলনের কিছু প্রাচীন নথিতে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সাল থেকেই তারার উদয় সময় লিপিবদ্ধ ছিল, তবে চীনা পান্ডুলিপির মতো জ্যামিতিক বিন্যাস ও স্থানাঙ্ক পদ্ধতি সেখানে দেখা যায় না।
এই তালিকার টিকে থাকা এবং পরবর্তী যুগে হালনাগাদ হওয়া চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা ও গভীরতাকে তুলে ধরে। গবেষক হে ও ঝাও এখন অন্যান্য প্রাচীন চীনা নক্ষত্র তালিকা ও মিং রাজবংশের যুগে চীন-ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান মেলবন্ধনের দিকেও দৃষ্টি দিচ্ছেন।
তাদের গবেষণা চীনের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ওই আহ্বানের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ “সভ্যতা পারস্পরিক বিনিময় ও শেখার মাধ্যমে বিকশিত হয়।”
এই গবেষণা বর্তমানে Research in Astronomy and Astrophysics জার্নালে পর্যালোচনার অপেক্ষায় রয়েছে এবং মানবজাতির প্রাচীনতম জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক রেকর্ডের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে।
আফরোজা