ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

বিমানে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার

মো. জাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৮:২৬, ২৫ জুন ২০২৫

বিমানে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার

আকাশে পথে বিমানের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখার পেছনে রয়েছে জটিল ও উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পরও বিমান দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। বিমান একটি জটিল ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন সিস্টেম এবং সিগন্যালের ওপর নির্ভর করে কাজ করে। ফ্লাইট কন্ট্রোল, নেভিগেশন, ইঞ্জিন এবং অন্য সিস্টেমগুলো সিগন্যাল ব্যবহার করে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বিমানের কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাইলট, ককপিট, রেডিও সিগনাল এবং বিশ্বব্যাপী এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল নেটওয়ার্ক একসঙ্গে কাজ করে প্রতিটি বিমানকে গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছে দেয়। বিমানের নিরাপত্তা মানেই যাত্রীদের প্রাণ সুরক্ষিত থাকা। বর্তমানে বিমান চালনা যত জটিল ও দ্রুত হচ্ছে, নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য প্রযুক্তির ভূমিকা ততই বেড়ে চলেছে। আকাশপথকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ইতিহাসে কিছু ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা রয়েছে। সেগুলো কেবল প্রাণহানিই নয়, বরং পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। আবিষ্কারের পর থেকেই প্রয়োজনের তাগিদে এখন পর্যন্ত বিমানে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য নিরাপত্তা টুল। আধুনিক যুগের আবিষ্কৃত এসব টুল বিমানযাত্রাকে নিরাপদ রাখতে বিশেষ সহায়তা প্রদান করে চলেছে। আধুনিক এসব প্রযুক্তি একসঙ্গে কাজ করার ফলে এখন বিমান চলাচল অনেক নিরাপদ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে বিমান যাত্রাকে আরও নিরাপদ করে তোলা হবে। এর পরও অনাকাক্সিক্ষতভাবে কারিগরি ত্রুটি, মানবিক ভুল কিংবা খারাপ আবহাওয়ার কারণে ঘটেছে বিভিন্ন ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বিমানের প্রতিটি দুর্ঘটনা আমাদের শেখায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন কতটা জরুরি। বিমান উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় আকাশে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ হয় প্রায়ই। যাকে বলা হয় ‘বার্ড স্ট্রাইক’। যা বিমান চলাচলের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। বিমান যখন রানওয়ে থেকে ছাড়ে বা অবতরণ করে তখন এর গতি কম থাকে।  তখন বিমান ভূমির কাছাকাছি থাকে। এই সময়টাতেই পাখিদের সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশেষ করে বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় যদি খোলা জলাশয়, খাদ্য সংস্থান বা গাছপালা থাকে তবে সেখানে পাখির আনাগোনা বেশি দেখা যায়। পাখির শরীরের মাংস বা পালক ইঞ্জিনে ঢুকে জ্বালানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে আগুন লাগাতে পারে, যা বিমানের জন্য খুবই বিপজ্জনক। এছাড়াও এক বা একাধিক ইঞ্জিন অকেজো হয়ে গেলে বিমানের উড্ডয়ন বা অবতরণ সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হয়। যদি রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের ঠিক পরেই এটি ঘটে তাহলে জরুরি অবতরণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বর্তমানের প্রয়োজনের তাগিদে আগামী দিনগুলোতে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে। নতুন সেসব প্রযুক্তি আকাশপথের যাত্রাকে আরও সুরক্ষিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাবে। বিমানের যাত্রীরা যখন  বিমানযাত্রায় থাকেন তখন এই ‘অদৃশ্য সংযোগ ব্যবস্থাই’ বিমান যাত্রীদের আকাশপথের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক বিমান আকাশে উড়ে বেড়ায়। প্রতিটি বিমানের উড্ডয়ন থেকে অবতরণ পর্যন্ত রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিমান এবং ভূমির মধ্যে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো অতি উচ্চ কম্পাংক (VHF-Very High Frequency) এবং উচ্চ কম্পাংক (HF-High Frequency) রেডিও। অতি উচ্চ কম্পাংক রেডিও সাধারণত ৩০-৩০০ মেগাহার্জ  (MHz) ব্যান্ডে কাজ করে থাকে। যা মূলত ২০০-২৫০ কিমি পর্যন্ত কার্যকর থাকে। বিমান যখন রানওয়ের কাছাকাছি থাকে তখন এই রেডিওতেই মূলত যোগাযোগ হয়। উচ্চ কম্পাংক (HF) রেডিও ব্যবহার হয় মূলত অধিক দূরত্বের অর্থাৎ মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে যেখানে অতি উচ্চ কম্পাংকতে (VHF) সিগনাল পৌঁছায় না। উচ্চ কম্পাংক রেডিও আয়নোস্ফিয়ারের সাহায্যে পৃথিবীর অনেক দূর পর্যন্ত সিগনাল পাঠাতে পারে। বিমানের সামনের অংশে থাকা ককপিট থেকেই সব ধরনের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করেন পাইলট ও সহ-পাইলট (co-pilot)। প্যানেলে থাকা রেডিও কন্ট্রোল ইউনিটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি নির্বাচন করে পাইলটরা সংশ্লিষ্ট এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (ATC-Air Traffic Control) বা বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ এর সঙ্গে কথা বলেন। এই এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (Air Traffic Control) বা বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণের  রেডিও বার্তার মাধ্যমেই নির্দেশ মেনে বিমান কখন কোথা দিয়ে যাবে, কোন উচ্চতায় থাকবে, কখন ঘুরবে বা অবতরণ করবে—সবকিছু ঠিক হয়। বিমানের মধ্যে বিভিন্ন সেন্সর থেকে প্রাপ্ত সিগন্যাল বিভিন্ন সিস্টেমকে তথ্য সরবরাহ করে থাকে। যা বিমানের কার্যক্রমকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ইঞ্জিন থেকে আসা তাপমাত্রা এবং চাপের সিগন্যাল কন্ট্রোল সিস্টেমে যায় এবং সেই অনুযায়ী ইঞ্জিন কাজ করে। প্রতিটি বিমানেই একটি ব্ল্যাক বক্স থাকে। বিমান দুর্ঘটনার যে কোনো তদন্তে ব্ল্যাক বক্স ব্যবহৃত হয়। এভিয়েশন বা বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এটিকে ব্ল্যাক বক্স না বলে ফ্লাইট রেকর্ডার নামে চেনেন। মূলত বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে এই ব্ল্যাক বক্স বা ফ্লাইট রেকর্ডারই সবার আগে খোঁজা হয়। নাম ব্ল্যাক বক্স হলেও বস্তুত পক্ষে এটি কালো কোনো বস্তু নয়। বরং এর রং অনেকটা কমলা ধরনের। এটি অত্যন্ত শক্ত ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। এই ব্ল্যাক বক্স কয়েকটি লেয়ার দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে প্রচণ্ড উত্তাপ, ভাঙচুর, পানি বা প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও এটি টিকে থাকতে পারে। এটি ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও অক্ষত থাকতে পারে। বাক্সটি উজ্জ্বল কমলা রঙের হওয়ায় সেটি খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। 
সমুদ্রের তলদেশেও ৩০দিন পর্যন্ত এটি অক্ষত থাকতে পারে। স্টেইনলেস স্টিল বা টাইটেনিয়ামের খোলস দিয়ে বাক্সের আবরণ তৈরি করা হয়। টিকে থাকার অনেকগুলো পরীক্ষায় পাস করার পরেই এগুলোকে বিমানে সংযোজন করা হয়। তা দুটি অংশের সমন্বয়ে একটি ইলেকট্রনিক ভয়েস রেকর্ডিং ডিভাইস। এটা মূলত ফ্লাইট রেকর্ডার প্রযুক্তি। বিমান চলাচলের সময় সব ধরনের তথ্য এটি সংরক্ষণ করে রাখে। এই বক্সে দুই ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। একটি হলো ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার (এফডিআর)। অপরটি হলো ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর)। এই ব্ল্যাক বক্স বা ফ্লাইট রেকর্ডারের মধ্যে বিমানের সমস্ত তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আধুনিক ব্ল্যাক বক্সগুলোয় ২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিমানের ফ্লাইট ডাটা ধারণ করে রাখতে পারে। এর ভেতর অনেকগুলো মেমরি চিপ পাশাপাশি সাজানো থাকে। এখানে তথ্য সরবরাহ করার জন্য বিমানের বিভিন্ন জায়গায় অনেক সেন্সর লাগানো থাকে। এসব সেন্সর অনবরত বিমানের গতি, তাপমাত্রা, সময়, ভেতর-বাইরের চাপ, উচ্চতা ইত্যাদি বিমানের সামনের দিকে থাকা ফ্লাইট ডাটা অ্যাকুইজিশন ইউনিট নামের একটি অংশে পাঠাতে থাকে। সেখান থেকে সেসব তথ্য চলে যায় ব্ল্যাক বক্সে রেকর্ডারে। বিমানে পাইলট, কো পাইলট, ক্রুদের বসার কাছাকাছি জায়গায় অনেকগুলো মাইক্রোফোন বসানো থাকে। তাদের সকল কথাবার্তা, নড়াচড়া বা সুইচ চাপা ইত্যাদিসহ সকল তথ্য এসব মাইক্রোফোনে রেকর্ড হতে থাকে। সেগুলো অ্যাসোসিয়েটেড কন্ট্রোল ইউনিট নামের একটি ডিভাইসে পাঠায়। এরপর সেসব তথ্য ব্ল্যাক বক্সে গিয়ে জমা হয়। বিমান চলাচলের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্ল্যাক বক্স তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। মূলত শেষের দিকের তথ্য এটিতে জমা থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আগের তথ্য মুছে যেতে থাকে আর নতুন তথ্য জমা হয়। ফলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ তথ্য এটিতে পাওয়া যায়। কোনো বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে এটি খুঁজে বের করাই হয়ে পড়ে উদ্ধারকারীদের প্রধান লক্ষ্য। মূলত  এটি পাওয়া গেলে সহজেই ওই দুর্ঘটনার কারণ বের করা সম্ভব হয়। ব্ল্যাক বক্সটি পাওয়ার পরেই বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী, বিমান সংস্থ, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি দল তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিবিদদের সমন্বয়ে তারা ব্ল্যাক বক্স থেকে তথ্য উদ্ধারের কাজটি শুরু করেন। বাক্সের অবস্থার ওপর নির্ভর করে এটি থেকে কত তাড়াতাড়ি তথ্য পাওয়া যাবে। সেটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেক সময় মাসের পর মাসও তথ্য উদ্ধারে সময় লেগে যায়। তথ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের খেয়াল রাখতে হয় যাতে তথ্য উদ্ধার করতে গিয়ে কিছু মুছে না যায় বা মেমরি চিপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিছু দুর্ঘটনা মাঝেমধ্যে আমাদের মনে করিয়ে দেয়-এই প্রযুক্তিনির্ভর যাত্রাও সর্বদা নিরাপদ নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিমান দুর্ঘটনার প্রায় ৬০-৭০ শতাংশই ঘটে পাইলট বা কন্ট্রোল টাওয়ারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। ভুল সময়ে অবতরণ, উড্ডয়নে বিলম্ব, বা পরিস্থিতি মূল্যায়নে ভুল থেকেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আবার ঝড়, বজ্রপাত, ঘন কুয়াশা, তীব্র তাপমাত্রা অথবা তুষারপাতের মতো খারাপ আবহাওয়া বিমান চালনায় বাধা সৃষ্টি করে। অনেক সময় ঘূর্ণিঝড় বা বিদ্যুৎপূর্ণ মেঘের কারণে বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। 
লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×