ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

টাকা সাদা করার বিধান বাতিল হলো

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ২৫ জুন ২০২৫

টাকা সাদা করার বিধান বাতিল হলো

অবশেষে কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল হলো। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করার সময় ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ’ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এর আগে প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনা এবং ভবন নির্মাণে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২২ জুন বিকেলে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। প্রতিবছর বাজেট এলে কালো টাকা সাদা করা নিয়ে আলাপ-আলোচনা দেখা যায়। শুরুতে সুযোগ না দেওয়ার হুমকি-ধমকি থাকলেও কেন জানি শেষ মুহূর্তে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়ে যায়। এটা গত কয়েক দশকেরই নিয়মিত চিত্র। কালো টাকার ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত তা নিয়ে বাস্তবসম্মত নীতির অভাব আমরা দেখে আসছি। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক ব্যাপারে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও কালো টাকার ব্যাপারে পুরনো পথেই থেকে যায়।
যে টাকার আয় ও আয়ের উৎস ঘোষণা না দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়া হয় বা যায়, যে টাকা অবৈধভাবে অর্জিত, সে টাকাই কালো টাকা। এ কালো টাকাই যে কোনো অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য, প্রতারণা, বঞ্চনা, অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যত্যয়ের প্রমাণক, অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি ও ন্যায়নীতি নির্ভরতাহীনতারই সূচক এবং অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিচ্যুতির মাধ্যমে সমূহ ক্ষতি সাধনের প্রভাবক ভূমিকা পালন করে। এ প্রেক্ষাপটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নানা আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ উঠে আসে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা ব্যাখ্যার বাতাবরণে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখাটাই কালো নীতি এবং এ ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচের মধ্যে কালো টাকার মালিক এবং কর ‘আদায়’কারী কালো টাকা সাদা করার নামে তাদের আয়-উপার্জনকে আরো কালো করার পথে পা বাড়ায়।
কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও এর যথা বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। সরকার পরিচালিত রাজনৈতিক অর্থনীতি বা নির্বাহী বিভাগের নয়। কেননা কালো টাকা তো সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি; স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়-নীতির জায়গায় ব্যর্থতার প্রতিফল। সাম্প্রতিক নজির থেকে দেখা যায়, তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার পর হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে। এসব দেশ প্রথম পর্বে কালো টাকাকে মূল স্রোতে নিয়ে আসতে সাদা করার সুযোগ দিত। পরবর্তী সময় শক্ত হাতে কালো টাকা সৃষ্টির উৎস বন্ধ করার রাষ্ট্রীয় প্রতিবিধান জোরদার করার ফলে সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতিসঞ্চার হয়েছে। আর খোলাসা করে বলা যায়, যেমন সুহার্তোর ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের শাসনকে ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নতত্ত্বে¡‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আখ্যায়িত করা হতো। 
গত দুই দশকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ায় অর্থবহ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে। ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) পর্যবেক্ষণ অনুসারে বলা যায় সামান্য কিছু অর্থ দুর্নীতিবাজরা ১০-১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে নিলে ওই বৈধকরণের নথিপত্রগুলো তাদের হাজার হাজার কোটি কালো টাকা নিরাপদে রেখে দেওয়ার ভালো দালিলিক সুরক্ষা দিতে পারে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকা আড়াল করার ভালো ব্যবস্থার সুবাদে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের মানেই হলো একটা সুনির্দিষ্ট সমঝোতা-নেটওয়ার্কের সহায়তায় দুর্নীতিবাজরা নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমর্থ হচ্ছে। এটি দৃশ্যত দুর্নীতিবাজদের জন্য সম্ভাব্য দুর্নীতি দমনের জাল থেকে পলায়নের পথ খুলে দেওয়ার শামিল। এ ব্যবস্থা রাখার মাধ্যমে কালো টাকার মালিকদের সিগন্যাল দেওয়া হচ্ছে যে, এ সুবিধা নিলে তাদের দুর্নীতিকে দমন করা হবে না।
কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ’অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার প্রয়াস দেখা যায়, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না’। সংবিধানের এ বিধানমতে ‘অনুপার্জিত আয়’ যদি কালো টাকা হয় তাহলে কালো টাকার সংজ্ঞা ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ এবং এ সংজ্ঞা দুর্নীতির সঙ্গে কালো টাকার ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। 
তবে এটা অনস্বীকার্য যে অনেক সময় বৈধভাবে অর্জিত অর্থের ওপর যেমন- জমিজমা, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট, দোকান ইত্যাদি রিয়েল এস্টেট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রকৃত দাম না দেখিয়ে কম দাম দেখালে রেজিস্ট্রেশন খরচ, স্ট্যাম্প খরচ, সম্পদ কর ও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে কালো টাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বলাই সংগত এবং তা প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই বিদ্যমান কর-হার হ্রাস করে নয়, উপরন্তু জরিমানা দিয়ে তো বটেই এবং কোনো অবস্থাতেই কোনো সংস্থা তাকে প্রশ্ন করতে পারবে না এ ধরনের অ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমা দিয়ে নয়। প্রসঙ্গত, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০০৮) প্রযোজ্য করসহ বছরপ্রতি ১০ শতাংশ হারে (সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ) জরিমানা দিয়ে এ জাতীয় অপ্রদর্শিত আয় ‘প্রদর্শন’ বা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সময় শেষ হওয়ার পর যাদের কাছে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা পাওয়া যেত তাদের বিরুদ্ধে আয়কর আইনেই জেল-জরিমানার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল।
আশির তুলনায় নব্বই দশক থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে বাড়তে তখনকার সাড়ে ৪-৫ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছলেও এ প্রবৃদ্ধির সুফল প্রধানত কয়েক হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত হয়েছে। সেজন্যই মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১২-১৭ সালে এ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক ব্যক্তিদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ণীত হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ক্ষমতার পালাবদলের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সুযোগ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে সে সময় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত থাকলে তা নির্ধারিত হারে আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধানটি বহাল রাখা হয় এবং নতুন বাজেটে সেটা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব নিয়েই বর্তমান বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও সে সময় বলা হয়েছিল ‘রাজস্ব বোর্ড একটি সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়ানুগ ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অঙ্গীকার বদ্ধ।’ উপদেষ্টা পরিষদেও পুরো বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আংশিক বাতিল করে সবচেয়ে বিতর্কিত বিধানটি কেন ৩০ জুন ২০২৫ বলবৎ রাখে এবং এবারের বাজেটে এটা-সেটা বলে তা রাখার প্রসঙ্গটি সামনে এনে পরিস্থিতিকে বিব্রতকর অবস্থায় আনা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। প্রসঙ্গত ইতোমধ্যে ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক করদাতা কালো টাকা সাদা করেছেন। যেমন- জমিতে ১ হাজার ৬৪৫ জন, ফ্ল্যাটে ২ হাজার ৮৭৩ জন ইত্যাদি (পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী)। এনবিআর এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করলে রাজস্ব আদায়ের অংকে সেটি সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা দেখার সুযোগ মিলত।
কালো টাকা সাদা করার এ নীতির ন্যায্যতা ও সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত যে বছরের পর বছর ১০ শতাংশের নিচে রয়ে যাচ্ছে, তার অনেক কারণের মধ্যে এমন অনৈতিক নীতির পরিপোষণও একটি। কয়েক বছর আগে কালো টাকায় কেনা স্থাবর সম্পত্তি এখন নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হলে বিগত বছরগুলোয় এ সম্পত্তি ব্যবহারজাত আয়ের ওপর কর আহরণের বিষয়েও ছলচাতুরীর প্রশ্রয় দেওয়া হবে। স্থাবর সম্পত্তি ও গৃহায়ন খাতে মূল্যস্ফীতির সুযোগ বেড়েছে। এই নজিরের ফলে এ ধরনের খাতে কর প্রদানে বিলম্ব বা বিরত থাকার প্রবণতা বাড়ছে। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’ এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোনো অর্থ-বিত্তকে কালো টাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেটাই সাংবিধানিকভাবে বেশি যৌক্তিক। জরিমানা ছাড়া অত্যন্ত হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুযোগ এবং ’অর্থের উৎস নিয়ে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবেন না’ জাতীয় বিধানজারি বলবৎ থাকলে দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটজের কনসেপ্ট ‘নৈতিক বিপদ’ এর উপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। 
কোনো উদীয়মান অর্থনীতিতে উন্নয়ন অর্জনে সফল হওয়ার পরও যদি আয় ও সম্পদ বৈষম্য না কমে, বরং বাড়ে তাহলে বুঝতে হবে সেই অর্থনীতিতে এমন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, যার প্রতিষেধক আবিষ্কার ও প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। কালো টাকা সাদা করার মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা না করাই সমীচীন আর সেই কাজটিই করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

প্যানেল

×