
ছবি: সংগৃহীত
ইতিহাস জানে—যেখানে পরাধীনতা শুরু হয়, সেখানেই পারস্য দাঁড়ায় প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে। আধুনিক বিশ্বে ইরান একমাত্র দেশ, যেটি আধিপত্যবাদী শক্তির চোখে চোখ রেখে নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলে। আর তাই, ২০২৫ সালের জুনে যখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালায়, তখন তা ছিল শুধু একটি সামরিক আগ্রাসন নয়—ছিল একটি জাতির আত্মমর্যাদাকে দমন করার প্রয়াস।
কিন্তু ইতিহাসের নিয়মে, ইরান দমে না। ইরান উঠে দাঁড়ায়।
সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট: হামলার ছুতো, আসল উদ্দেশ্য
১৩ জুনের হামলা কোনো হঠাৎ রণকৌশল ছিল না। এটি ছিল বহুদিন ধরে গড়ে তোলা এক আগ্রাসী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। নাতানজ, ইসফাহান, আরাক এবং বিশেষত পাহাড়ের গায়ে তৈরি শক্তিশালী ফরদো পারমাণবিক কেন্দ্রের ওপর এই হামলা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দেয়—ইরানকে ঠেকাতে আজও কতটা মরিয়া পশ্চিমা বিশ্ব।
তবে ইরান বিষয়টি খুব সহজ করে দেখেনি। বরং এ হামলার প্রতিউত্তরে হরমুজ প্রণালি হয়ে ইরান ১৫০টির বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে দেয় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও ইসরায়েলের সামরিক অবকাঠামোর দিকে, যা গোটা বিশ্বের সামনে এক অঘোষিত বার্তা হয়ে দাঁড়ায়—“ইরান এখন আর ২০০৩ সালের ইরান নয়”।
পারমাণবিক শক্তি: অস্ত্র নয়, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক
জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থা IAEA বারবার স্বীকার করেছে—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবু ইরানকে যুদ্ধের অজুহাতে টার্গেট করা হয়, শুধু এ কারণে যে সে নিজের উন্নয়নকে নির্ভর করে না কারও অনুমতির ওপর। সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই-র ফাতওয়া অনুযায়ী, পারমাণবিক অস্ত্র ইসলাম বিরোধী ও মানবতার পরিপন্থি—এই নীতিতে ইরান অটল থেকেছে।
কিন্তু আজ যখন নিজেদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, বিজ্ঞানী ও গবেষণাগারগুলো বিদেশি আগ্রাসনের নিশানায় পড়ে, তখন প্রশ্ন জাগে—এই সংযমের মূল্য কি আরও ক্ষতি? ইরানের ভেতরে এখন উচ্চারণ হচ্ছে এক নতুন নীতি: “স্বাধীনতা সংরক্ষণের একমাত্র উপায়—সক্ষমতা নিশ্চিত করা।”
ফোর্ডো কেন্দ্র: ভূগর্ভে লুকিয়ে থাকা জাতির প্রতিরোধ
ইসরায়েল-আমেরিকা জোটের সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিল ফোর্ডো। পাহাড়ের নিচে প্রায় ৩০০ ফুট গভীরে অবস্থিত এ পারমাণবিক প্লান্টে গত ৩ মাসে তৈরি হয়েছে প্রায় ১৬৬ কেজি ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম—যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যথেষ্ট শক্তিশালী। ২২ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত B-2 বোমারু বিমান থেকে ছোড়া ৬টি GBU-57 বোমা ফরদোতে আঘাত হানে।
কিন্তু স্যাটেলাইট চিত্র আর বাস্তব তথ্য বলছে—বোমাগুলো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। প্রকৌশলগতভাবে ২০০ ফুটের বেশি গভীরতা অতিক্রম করে ৩০০ ফুটে পৌঁছে এক জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানো একেবারেই দুরূহ। ফলে, ফোর্ডোর মূল গবেষণা কোর রক্ষা পায়। এর আগেই ইরান কৌশলগতভাবে ইউরেনিয়াম ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলেছিল।
পরমাণু শক্তির ভবিষ্যৎ: নতুন যুগে প্রবেশের প্রস্তুতি?
বর্তমানে ইরান কূটনৈতিকভাবে ক্ষতিপূরণ চায়—জাতিসংঘ ও IAEA’র নীরবতায় সে ক্ষুব্ধ। আগামী দিনে ইরান যদি পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে মনোনিবেশ করে, তবে সেটা হবে আত্মরক্ষার জন্য, আগ্রাসনের জন্য নয়। এমনকি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (NPT) থেকেও ইরান সরে আসতে পারে—যা ঘটলে আন্তর্জাতিক নজরদারি আর কার্যকর থাকবে না।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে—ইরান কী পথে যাবে? কিন্তু ইরান ঠিক জানে: আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিরাপত্তা আসে না। বরং নিজের শক্তিতে দাঁড়ালেই আসে প্রকৃত শান্তি।
যুদ্ধ কি শান্তি আনল?
ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলো হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তা ধ্বংস হয়নি। বরং ইরানের জনগণ আজ আরও ঐক্যবদ্ধ, আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই হামলা ইরানকে আরও একবার ভাবতে বাধ্য করেছে—বিশ্বশান্তি যদি কিছু দেশের একচ্ছত্র অধিকার হয়ে ওঠে, তবে প্রতিরোধই একমাত্র উত্তর।
পারস্যের মাটি জানে আত্মত্যাগ কাকে বলে। সে পথেই ইরান এগিয়ে চলেছে—সম্মানের দিকে, স্বাধীনতার দিকে।
Mily