
ছবি: সংগৃহীত
"বাবা তুমি তো বলেছিলে পিতৃ ঋণ কখনো শোধ হয় না। তুমি ২৫ বছরে আমার পেছনে যে টাকা খরচ করেছো তুমি কি জানো, আমি আগামী দুই বছরে সে টাকা তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারবো"।
বাবা : মুচকি হেসে বলেছিলো, একটা গল্প শুনবি ? কমল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নিচু স্বরে বললো- "বলো বাবা শুনবো……"। তোর বয়স যখন ২ বছর আমার মাসিক আয় তখন ৩ হাজার টাকা। ওই টাকায় সংসার চালানোর কষ্ট বাড়ির কাউকে কখনো বুঝতে দেইনি। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে সব সময় চেষ্টা করেছি তোর "মা কে " সুখি করতে। তোকে যে বছর স্কুলে ভর্তি করলাম সে বছর আমি আর তোর মা পরিকল্পনা করেছি- আমরা তোর পড়ার খরচের বিনিময়ে কি কি ত্যাগ করবো।
সে বছর তোর মাকে কিছুই দিতে পারিনি আমি। তুই যখন কলেজে উঠলি আমাদের অবস্থা তখন মোটামুটি ভাল। কিন্তু খুব কষ্ট হয়েছিল, যখন তোর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ঔষধ কেনার জন্য রোজ পায়ে হেটে ঘামে ভিজে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে খুব কষ্ট হতো। কখনো কাউকে বুঝতে দেইনি এমনকি তোর মা কেও না।
একদিন শো রুম থেকে একটা বাইক দেখে আসলাম- স্কুলে যাওয়া-আসার জন্যে। কিন্তু পরের দিন তুই বায়না করলি ল্যাপটপের জন্য। তোর কষ্টে আমার কষ্ট হয় বাবা। আমি তোকে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলাম।
আমার তখনকার একশ টাকা এখন এক তোর কাছে হয়তো এক টাকা! কিন্তু মনে করে দেখ সেই টাকা দিয়ে তুই বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করেছিস। ব্র্যান্ড নিউ মোবাইলে হেড ফোন লাগিয়ে সারা রাত গান শুনেছিস। পিকনিক করেছিস, ট্যুর করেছিস, কন্সার্ট দেখেছিস। তোর প্রতিটা দিন ছিল স্বপ্নের মতো।
আর তোর একশ টাকা নিয়ে আমি এখন সুগার মাপাই। জানিস, আমার মাছ, মাংস, দুধ খাওয়া নিষেধ। কি করে এত টাকা খরচ করি বল! তোর টাকা নিয়ে তাই আমি কল্পনার হাট বসাই। সে হাটে আমি বাইক চালিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াই। বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যাই। তোর মায়ের হাত ধরে মেলায় ঘুরে বেড়াই।
বাবারা নাকি "একটু অন্যরকম হয়"। আমিও আমার বাবাকে তাই ভাবতাম। পুরুষ থেকে পিতা হতে আমার কোনো কষ্ট হয়নি। সব কষ্ট তোর মা সহ্য করেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, পিতা থেকে দ্বায়িত্বশীল পিতা হবার কষ্ট একজন পিতাই শুধু বোঝে। যুগে যুগে মাতৃবন্দনা হলেও পিতৃবন্দনা কোথাও দেখেছিস ?
পিতৃবন্দনা আমিও আশা করি না। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কোনো পিতা হয়তো প্রকাশ করতে পারে না। তবে কোনো পিতা কখনো সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে বিচ্যুত হয় না। আমি তোর পেছনে আমার যে কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করেছি তা হয়তো তুই দুই বছরে শোধ দিতে পারবি- কিন্তু যৌবনে দেখা আমার স্বপ্নগুলো ?
যে স্বপ্নের কাঠামোতে দাঁড়িয়ে তুই আজ তোর ঋণশোধের কথা বলছিস- সেই স্বপ্নগুলো কি আর কোনোদিন বাস্তবে রূপ পাবে ?
তোকে একটা প্রশ্ন করি, ধর তুই আমি আর তোর খোকা তিন জন এক নৌকায় বসে আছি। হঠাৎ নৌকাটা ডুবতে শুরু করলো…. যে কোন একজনকে বাঁচাতে পারবি তুই।
কাকে বাঁচাবি ? ( কমল হাজার চেষ্টা করেও এক চুল ঠোঁট নড়াতে পারছেনা!) উত্তর দিতে হবে না। ছেলেরা বাবা হয়, বাবা কখনো ছেলে হতে পারে না। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি জিনিস কি জানিস?
পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ! আমি শুধু আল্লাহর কাছে একটা জিনিস চাই। আমার শেষ যাত্রায় যেন আমি আমার ছেলের কাঁধে চড়ে যাই। তাহলেই তুই একটা ঋণ শোধ করতে পারবি–তোকে কোলে নেবার ঋণ।
আর যদি বলিস, বাবা আমি তোমার টাকা না তোমার ভালোবাসা তোমায় ফিরিয়ে দেব, তাহলে বলবো বাবার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়া যায় না!
লেখক: শরিফুল রোমান, শিক্ষক ও সংবাদকর্মী
আলীম