
অপেক্ষমাণ আর এক ধর্মীয় উৎসব কোরবানির আনন্দঘন ঈদ। ঈদুল আজহা ধর্মীয় গাম্ভীর্যে মুসলমানদের জীবনে আর এক পবিত্রতম উৎসব আনন্দ। যা মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি পরম নিবেদনের উৎসর্গও বলা যায়। আমরা ধর্মপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে পরিচিত ও স্বীকৃত। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সম্প্রীতির বাধনে নিজেদের যাপিত জীবন পূর্ণ করি। যা শুধু জাতিগত নয় চিরস্থায়ী মিলনযজ্ঞের অনন্য পারদর্শিতা। যুগ-যুগান্তরের নির্মল আবহে তৈরি হওয়া ধর্মীয় স্বজাত্যবোধেও মিলনের যে সুর ঝঙ্কার তাও উর্বর পলিমাটির এই বরেন্দ্র অঞ্চলের অম্লান সৌভাগ্য। তার ওপর সর্বমিলনের যে বন্ধনজাল তাও নানামাত্রিকে জনগোষ্ঠীকে এক কাতারে মিলিয়েও দেয়। বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি। যার কারণে জাতীয় আর ধর্মীয় পবিত্রতম পর্বও মহাসমারোহে আনন্দ আয়োজনে চিরস্থায়ী সমৃদ্ধ বলয়। তেমন এক অতি পবিত্রতম বিধি ঈদুল আজহা। যেখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার প্রতি নিবেদন, আকুতি কেমন যেন মিলেমিশে একাকার। শাশ্বত এক অমলিন সাধনযজ্ঞে ধর্মীয় বিধিবিধানও আমরা নিয়তই পালন করি। নামাজ, রোজা থেকে শুরু করে আনন্দ-উৎসবে দুই পবিত্র ঈদ- ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহাও আমাদের মাতিয়ে দেয়। অপেক্ষা করি আমরা ধর্মীয় এই বড় দুটি উৎসবের। দুই মাস আগে পার হয়ে গেল পবিত্র রমজান মাস আর খুশির বার্তায় ঈদুল ফিতর। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বহুমাত্রিক আনন্দের ধারা। এখন অপেক্ষা আর এক জমজমাট ঈদুল আজহার প্রস্তুতি পর্বের বহুমাত্রিক আয়োজন। পটভূমিতে কোরবানি ঈদের যে ধর্মীয় ব্যাখ্যা তাতে হজরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার ইতিবৃত্তে যে দুর্দান্ত ঘটনার অবতারণা তা আজও মুসলমানদের উজ্জীবিত, উৎসাহিত আর ধর্মীয় ভাবাবেগে মহান খোদাতালার নিকটবর্তী করে দেয়। প্রাণপ্রিয় পুত্রকে যখন আল্লাহর নিকট কোরবানি দিতে প্রস্তুত স্নেহশীল পিতা তেমন দুর্লভ সময়ে খোদাতায়ালার কাছ থেকে যে পরম নির্দেশ তাও এক অভাবনীয় দৃশ্যপট। অকুণ্ঠিত, দ্বিধাহীন হজরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করবেন। ততোধিক উদ্বেলিত স্বয়ং মহান আল্লাহ। তেমন অনন্য ক্ষণে সর্বশক্তিমান যা করলেন তাও বান্দার প্রতি পরম মমতা, সৌহার্দ্য আর অবিমিশ্র করুণা। শুধু কি তা-ই? ভক্তের অন্তর নিঃসৃত আবেদনে করুণাময় নিজেই স্থির করলেন- ইসমাইল নন শুধু পশু কোরবানিতেই মহান আল্লাহর পরম সন্তুষ্টির আর বান্দার প্রতি সুবিচারের অনন্য নিদর্শনও কি উপেক্ষা করার মতো? নিকটতম বান্দার প্রতি অনন্য রহমত আর ঔদার্যে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ফরমান আসল পশু কোরবানির মাধ্যমে আর এক ঈদের উৎসব আয়োজন মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় বিধি হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাবার।
তবে বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। তাই আড়ম্বর, উৎসাহ-উদ্দীপনায় যে মাত্রায় মেতে ওঠে সেখানে শুধু পশু কোরবানিই নয় আরও কত আয়োজন-আপ্যায়ন মিলিত স্রোতধারায় এক ও অভিন্ন হয়ে যায় সেটা ইসলামের অনন্য সাম্যের পরম নিবেদনের স্তুতি। আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ শুধু ধর্মীয় ভাবাবেগে নয় সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ বাতাবরণে কোরবানির যে প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে তাও পলিমাটির উর্বর অঞ্চলটির নিজস্ব বিত্তবৈভব।
কোরবানির আগে শুরু হয়ে যায় পশুর হাট বসার পরম আনন্দযজ্ঞের মহাসম্মিলিন। আবার তা সারা বছরেরও অনন্য কর্মসাধনা।
গরু খামারি কিংবা সম্পন্ন গৃহস্থরা নিজেদের গোয়াল ঘরেই সামনের কোরবানির জন্য গরু, ছাগল পুষতে থাকেন। পর্যাপ্ত খাওয়াই শুধু নয় যত্ন আত্তিতেরও কোনো ঘাটতি থাকে না। আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ বলে কথা। পবিত্রতম অনুভূতি যা ধর্মীয় বোধ থেকে উদ্বুদ্ধ তাও মিলে মিশে যেন একাত্ম। আর এই কোরবানির সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পবিত্র হজ পালনও। যেখানে সারা বিশ্বের বহু মুসলমানের এক সঙ্গে শুধুু নামাজ আদায় নয় ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধকেও পরিশুদ্ধভাবে জাগিয়ে তোলা। আর এক বৃহত্তর জমায়েত মুসলিম বিশ্বের। অভাবনীয় লোক সমাবেশের চিরস্থায়ী নির্মাল্য। ইসলাম সাম্য আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এক অবিস্মরণীয় মিলনযজ্ঞের পরম বার্তাবহ। সঙ্গত কারণে ধর্মীয় বিধিগুলোও সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে। আর্থিকভাবে সচ্ছল সম্পন্ন ব্যক্তিদের কোরবানি দেওয়া ফরজ। সেখানে কত নিয়মবিধি। অসচ্ছল নিকটজনদের মধ্যে তিন ভাগের এক অংশ দেওয়া ধর্মীয় আর এক শৃঙ্খল। আবার গরিব-দুঃখীদের মধ্যে তিন ভাগের ১ অংশ দিতে হয়। বাকি ১ ভাগ কোরবানি দেওয়া সম্পন্ন ব্যক্তির অবশিষ্ট থাকে। মুসলমানরা সচেতন সাবধানতায় কোরবানির বিধি মোতাবেক মাংস বিতরণে তেমন কোনো কার্পণ্যই করেন না। আল্লাহর প্রতি সমর্পণ আর নিবেদনের স্তুতিতে সর্বমানুষের জন্য নিতান্ত দায়বদ্ধতাও ইসলাম ধর্মের কঠিন বিধিনিয়ম তো বটেই। ঈদুল আজহা মানে শুধু কোরবানি দেওয়াই নয় তার চেয়ে বেশি পশুর হাট বসাও আর এক দৃষ্টিনন্দন আবহ। আগেই উল্লেখ করি গরু খামারি কিংবা গ্রামীণ সম্পন্ন মানুষরা সারা বছর কোরবানি দেওয়ার গরুকে খাওয়াইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে বাজারে নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। সেটাও আর এক অনন্য সাধনার নিয়ত পালাক্রম। এখন পশুর হাট বসার সুবর্ণ সময়। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য আনন্দ উৎসবের ধারাবাহিক চিত্রের ফি বছর নবতর উন্মাদনার পরম পালাক্রম। বিক্রেতারা যেমন পরম আগ্রহে বেচা-বিক্রির জন্য হাটে সরগরম থাকেন ক্রেতারাও সেভাবে কেনার লক্ষ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী গরু-ছাগল বাছাইয়ে তাদের সর্বশক্তি আর ক্ষমতাকে অতি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হয়। জমজমাট পশু বিক্রির হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই থাকেন পরম আকাক্সিক্ষত পশু আর ক্রয়-বিক্রয়ের অনন্য পরিবেশে। হাটে বাজারে গরু-ছাগলের বিকিকিনির মধ্যে তিল ধারণের ঠাঁই থাকেই না। শুধু কি হাটে-বাজারের ব্যস্ততা? ছোট পরিবারের গৃহিণীরাও অলস সময় পার করেন না। তাদের ব্যস্ততাও মাংস নিয়েই।
সেখানে মসলাপাতির জোগাড় করা, দা, বঁটি, ছুরি নতুনভাবে ধার দেওয়া। যাতে মাংস কাটতে কোনো রকম বিপাকে পড়তে না হয়। অনন্য এক কর্মব্যস্ত পরিবেশের দারুণ এক উপভোগ্য অবস্থা ঘরের সবাইকে মাতিয়ে দেয়। সাধারণত, পারিবারিক আঙিনায় কোরবানির জন্য জায়গা বরাদ্দ থাকে। কাছে- ধারে কোথাও গরু জবাই করার স্থান নির্ধারণও থাকে। আবার বসতবাড়িতে স্থান সঙ্কুলান হলে অনেক সম্পন্ন গৃহস্থ সেখানেই গরু-ছাগল জবাই করে থাকেন। পশুর চামড়া বিক্রির টাকাও গরিব আত্মীয়স্বজন ও দীন-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা আর এক ধর্মীয় বিধানও। সাম্য আর মৈত্রীর বাধনে ইসলাম ধর্ম সত্যিই এক মানবতার পরম জয়গানেও বিধিবিধানকে লালন-পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যা যুগ-যুগান্তরের চলে আসা এক সমতার বন্ধনকে দৃঢ় থেকে আরও শক্তিশালী করে দেয়। তেমন মহান ঈদুল আজহার জন্য এখন আমরা সবাই অধীর অপেক্ষায় দিন গুনছি।
প্যানেল