ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সীমান্ত সড়ক

পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

এ কে এম কায়েস

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৭ মে ২০২৪; আপডেট: ০০:১৮, ৮ মে ২০২৪

পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

সীমান্ত সড়ক প্রকল্প

‘প্রান্তিকে পৌঁছাবে কেন্দ্রের গতিময়তা/কেন্দ্রে যাবে প্রান্তের নৈসর্গিক আলো’

যেখানেই সীমান্ত তোমার, সেখানেই বসন্ত আমার- কুমার বিশ্বজিতের জনপ্রিয় এই গানে সীমান্ত নিয়ে যতটা রোমান্টিকতা রয়েছে, সীমান্তের বাস্তবতা ততটাই কণ্টকাকীর্ণ। বাংলাদেশের ৪,৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের কোথাও নদীনালা, কোথাও বা জলাভূমি অথবা বিস্তীর্ণ চর, কৃষিজমি, বসতভিটা, ঘন জঙ্গল, কোথাও বা দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল। বৈচিত্র্যময় এই সীমান্তরেখা ঘিরে যেমন সম্ভাবনা আছে অবারিত, তেমনি আবার নানা সংকট আবর্তিত হয় সীমান্ত ঘিরেই।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান ও ভাগ্য উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায়  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তে বদলে যেতে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা। ২০১৫ সালে দীর্ঘ সাত দশকের টানাপোড়েনের ইতি ঘটিয়ে ছিটমহল বিনিময় করে বাংলাদেশ ও ভারত। কয়েক বছরের নিরন্তর কূটনৈতিক তৎপরতার সাফল্য ছিল ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়। ফলশ্রুতিতে, বেহাত ভূখ-ের নিয়ন্ত্রণসহ সীমান্তের কয়েক দশকের দুঃখ ঘোচে।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর সীমান্ত পিলার থেকে মুছে ফেলা হয় পাকিস্তানের নাম। ২০১৫ সাল পর্যন্তও দেশের ৬৫টি মেইন পিলার, ৪৫৫টি সাব পিলার ও ৫ হাজারের বেশি টি-পিলারের একপাশে ভারত ও অন্যপাশে পাকিস্তান লেখা ছিল। ২০১৯ সাল নাগাদ তা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের নামাঙ্কিত হয়। বর্তমান সরকারের দৃঢ়  নেতৃত্বে যখন গতিশীল হয় জাতীয় অর্থনীতির চাকা, যখন সমৃদ্ধির পথে গতিশীল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ, তখন সীমান্ত নিয়ে আরও এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী।

দুর্গম পার্বত্য এলাকার প্রত্যন্ত সীমান্তে বইতে শুরু করে জাতীয় সমৃদ্ধির সুবাতাস। স্বাধীনতার কয়েক দশক পরেও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের কয়েকশ’ কিলোমিটার সীমান্ত ছিল অরক্ষিত, যা আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানকে যুক্ত করে চলমান এই সীমান্ত সড়ক অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। উঁচু পাহাড়, গভীর খাত, আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের অপতৎপরতা, পরিবহন এবং যোগাযোগ চ্যালেঞ্জ ইত্যাদিকে পিছনে ফেলে সীমান্ত সড়ক এখন দেখছে আলোর মুখ।
     
সীমান্ত সড়ক কী এবং কেন
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গমতাকে সহজে বোঝানো সম্ভব নয়। এখানে দূরত্ব কিলোমিটারে মাপা হয় না, মাপা হয় সময় দিয়ে। বলা হয়ে থাকে, অমুক জায়গা থেকে অমুক জায়গায় যেতে ২ দিন হাঁটতে হবে। হয়তো ৩ কিলোমিটার খাড়া পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে লেগে যায় আধাবেলা। পিচ্ছিল ঝিরি বেয়ে এক কিলোমিটার পাড়ি দিতে লেগে যাবে কয়েক ঘণ্টা। কখনও হাঁটা পথ, কখনও স্রোতের প্রতিকূলে পাহাড়ে উঠছে ইঞ্জিননৌকা।

আর তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সীমান্ত সুরক্ষার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয় সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ। শুরু হয় এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের মহাযজ্ঞ। এই সীমান্ত সড়ক প্রকল্প পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি স্থানীয় অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পর্যটন ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।

স্থানীয় পাহাড়ি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক সামঞ্জস্য এবং একতার বন্ধন আরও দৃঢ় করবে। কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ সহজ হবে, যা কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির উন্নতি ঘটাবে। সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে এক বৃহৎ পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে অনেক নতুন শিল্প এবং কারখানা গড়ে উঠতে পারে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতির গতিপথ পরিবর্তন করবে।

বিশেষ করে, কৃষি সম্ভাবনার কারণে এখানে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তা স্থানীয় উৎপাদন এবং রপ্তানির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে। সীমান্ত সড়কের এই প্রকল্প অঞ্চলটির জন্য নতুন এক যুগের সূচনা করবে নিঃসন্দেহে। এই সড়ক হয়ে উঠবে পার্বত্য এলাকার জীবনরেখা, যা সমগ্র বাংলাদেশের জন্য করবে এক নতুন দিগন্তের রচনা।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে এ সড়ক। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থলপথে যোগাযোগ বাড়বে। রামগড় বন্দর চালু হলে তাতে অবদান রাখবে সীমান্ত সড়ক। ফলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

একটা সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর যাতায়াত ছিল কষ্টের। বিশেষ করে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে সদরে যেতে গেলে গলদঘর্ম অবস্থা হতো। যতটুকু সীমান্ত সড়ক হয়েছে, তাতেই সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে স্থানীয়রা। হাসপাতালে যেতে পারছে সহজেই। পুরো সড়ক শেষ হলে নিশ্চিত হবে পাহাড়ি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাও। লোকালয়ে এসে অপরাধ করে গহীন অরণ্যে অনায়াসেই সটকে পড়ছে দুষ্কৃতকারীরা।

যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বল দশার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বেগ পেতে হয়। সেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাবে এই সড়ক। সীমান্তরক্ষীরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় সীমান্ত সড়ক ধরে কম সময়ের মধ্যেই অনেকটা জায়গাজুড়ে টহল দিতে পারবে। একই সঙ্গে পুরো সীমানা থাকবে নখদর্পণে। অন্যান্য দেশের সীমান্ত সড়কের দিকে তাকালেই এই সড়কের গুরুত্ব খুব সহজেই বোধগম্য হবে। সীমান্তরেখার সমান্তরালে সেই রাস্তা ধরে সহজে এবং দ্রুততার সঙ্গে সীমান্ত পাহারা দেয় পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

বাংলাদেশের সীমান্ত সড়কের কাজ শেষ হলে বিজিবি হবে আরও গতিশীল ও দায়িত্বপূর্ণ। বর্তমানে সীমান্তরেখা বরাবরে চলমান মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধকেন্দ্রিক উদ্বিগ্নতা বা বান্দরবানের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এবং অন্যান্য সশস্ত্রগোষ্ঠী এই অঞ্চলের দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক কাজ করে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে যায়। তা অবসান করার ক্ষেত্রে সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে প্রতীয়মান।  
 
১০৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক
সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি থেকে শুরু হয়ে বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত মোট ১,০৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ৩ পার্বত্য জেলার ১২টি উপজেলা এক অভিন্ন যোগাযোগ সূত্রে গাঁথা হবে। যা স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নতিতে বিশেষভাবে অবদান রাখবে।  প্রথম পর্যায়ে, প্রাথমিকভাবে ৩১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের কাজ হাতে নেওয়া হয়।

যার মধ্যে ৯৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংযোগ সড়কগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে অবদান রাখছে। ভারত এবং মিয়ানমার সীমান্তে নির্মিত সড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১২৪ ও ৯৬ কিলোমিটার। প্রথম পর্যায়ের ৮৫% কাজ অর্থাৎ প্রায় ২৭০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের আরও ৩৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। যার মধ্যে ১০৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ পর্যায়ে ভারত সীমান্তে আরও ২০১ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার সীমান্তে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের নির্মাণ কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রায় ৩০৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার মধ্যে মিয়ানমার সীমান্তে ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক অন্তর্ভুক্ত।

এই পর্যায়টি আরও সম্প্রসারণ এবং সীমান্ত অঞ্চলের উন্নতি সাধনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পের প্রাক্কলিত বাজেট ৩,৮৬০.৮২ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। 

সীমান্ত সড়কের গুরুত্ব
যোগাযোগের উন্নতি- সীমান্ত সড়ক পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এবং প্রত্যন্ত এলাকায় যোগাযোগের সুবিধা ব্যাপকভাবে উন্নত করবে। এর ফলে এলাকাগুলো আর বিচ্ছিন্ন থাকবে না। বরং জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উঠবে। যোগাযোগের এই উন্নতি স্থানীয় জনগণের জীবনমান এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন- সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষি ও কুটির শিল্প উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।

সীমান্ত এলাকায় উৎপাদিত পণ্যগুলো বৃহত্তর বাজারে সহজে পৌঁছাতে পারবে সহজেই। যা উৎপাদনের পরিমাণ এবং মান উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে। এর ফলে, স্থানীয় অর্থনীতি গতিশীল হবে এবং জাতীয় উন্নয়নের অংশ হয়ে উঠবে।
শিক্ষার উন্নয়নÑ দুর্গম এলাকাগুলোতে উন্নত যোগাযোগের সুবিধার শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে এবং দক্ষ শিক্ষকরা সহজে সেখানে পৌঁছাতে পারবেন। এর ফলে শিক্ষার মান এবং প্রসার ঘটবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।

স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি- সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সম্ভব হবে। এটি জরুরি চিকিৎসার জন্য রোগীদের দ্রুত আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব করে তুলবে। যা জীবন রক্ষায় অপরিসীম ভূমিকা রাখবে।
কৃষি উন্নয়নÑ পাহাড়ের মাটি সমতলের চেয়ে ব্যতিক্রমী। উর্বরতার কারণে পাহাড়ে নানা ধরনের ফল, শাকসবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে এসব পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতো স্থানীয়রা, সীমান্ত সড়ক হলে কৃষিপণ্য দেশের মূল ভূখ-ে পরিবহনের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে। 
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারÑ সীমান্ত সড়কের মাধ্যমে স্থানীয় পণ্যগুলো বড় বাজারে সহজে পৌঁছানো যাবে। যা ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটাবে। এছাড়াও নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনা বাড়বে। যার ফলে, স্থানীয় উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে।
পর্যটন উন্নয়নÑ সীমান্ত সড়ক দুর্গম এবং অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক হেরিটেজ এলাকাগুলোতে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। এর ফলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। যা স্থানীয় জনগণের আয়ের উৎস সৃষ্টি করবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাÑ সীমান্ত সড়কের কাজ সমাপ্ত হলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের বর্ডার অবজারভেশন পোস্টগুলো সীমান্ত সড়কের আশপাশে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। সক্রিয় উপস্থিতির কারণে সীমান্তরেখার সমান্তরালে সীমান্ত সড়ক টপকে এপারের সন্ত্রাসীরা ওপারে আশ্রয় নিতে পারবে না। দুর্গম পথ সুগম হওয়ার ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গা ঢাকা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। যে কোনো স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চালানো সহজ হবে। ফলে, আরও নিরাপদ হয়ে উঠবে পার্বত্য অঞ্চল। যা সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
সীমান্ত অপরাধ দমনÑদুর্গমতার সুযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসীরা সীমান্তের উভয় পাশে অবাধ যাতায়াত, অপহরণ, পলায়ন, ঘাঁটি নির্মাণ, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের মতো নানা ধরনের সীমান্ত অপরাধ করার সুযোগ পায়। সীমান্ত সড়ক নির্মিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত প্রহরা, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ফলে, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ ও চোরাচালান কমবে। সীমান্ত সড়কের ইতিবাচক দিকগুলো তাই সকলকে অবহিত করতে হবে।

দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী উপজাতি এবং নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে সীমান্ত সড়কের ইতিবাচক দিকসমূহ তুলে ধরতে পারলে তাদের মধ্যে সড়ক নিয়ে যে সংশয় রয়েছে, তা অনেকাংশে দূর হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত সড়কের দুই পাশের পাহাড়ের নৈসর্গিকতাকে রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বর্ণিল জীবনধারা, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি-এই তিন জেলাকে বিশেষভাবে করেছে বৈশিষ্ট্যম-িত। এ অঞ্চলকে নিয়ে বারবার বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় শান্তির পরিবর্তে সংঘাত উসকে দিয়েছিল। সীমান্ত সড়কের ইতিবাচক দিকগুলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায় অবহিত হলে তাদের সংশয় দূরীভূত হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত সড়কের দুই পাশে পাহাড়ের নৈসর্গিকতাকে রক্ষা করার দিকেও সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সামগ্রিকভাবে সীমান্ত সড়ক প্রকল্প পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। যা স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রসার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো বিভিন্ন দিকে অবদান রাখবে।

লেখক : কর্নেল, এসজিপি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি

×