
.
দ্রুত নগরায়ণের প্রভাবে শহরের পরিধি বাড়ছে। আবার শহর ছেড়ে মানুষের গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রতিহাজারে প্রায় ১৪ জন গ্রামে ফিরেছে। পাঁচ বছর আগে এ হার ছিল গড়ে একজনের কম। গত পাঁচ বছরে বিদেশ গমনের হার বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাবে জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ায় মানুষ শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে যাচ্ছে মানুষ। বর্তমানে বিনিয়োগ কম থাকায় নতুন কর্মসংস্থানের অভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র সামনে নিয়ে আসছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, শহরের তুলনায় গ্রামে এখন কৃষি, মৎস্য চাষসহ নানা ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই মাটির টানেও মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে প্রতিহাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ১৩ দশমিক ৮ জন। আগের বছর এ হার ছিল ১০ দশমিক ৯। ২০২১ সালে প্রতিহাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ৫ দশমিক ৯ জন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪। ২০১৯ সালে প্রতিহাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে একজনের কম বা দশমিক ৭ জন। মানুষের গ্রামমুখী হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে, এক– শহরের পুশ ফ্যাক্টর বা গ্রামের পুল ফ্যাক্টর এখানে কাজ করে থাকতে পারে। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় মানুষ হয়তো শহরে চলতে পারছে না। কাজ করতে পারছে না বা কাজের আয় দিয়ে শহরে টিকতে পারছে না, দুই– গ্রামে হয়তো শোভন কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তাই মানুষ গ্রামে যাচ্ছে। বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো না হওয়ায়, শহরে নতুন কর্মসংস্থান না থাকায় মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীন লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। অর্থাৎ, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব সামনে আসছে। তৃতীয়ত– গ্রামে এখন কৃষি ছাড়াও মৎস্য, পোলট্রি, বনায়ন, কুটির শিল্প এবং নানা ধরনের অকৃষিকাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং সেবা, ফার্নিচারের দোকান, ইলেকট্রিক, সিলিন্ডারের দোকান দিচ্ছে মানুষ। জমি কেটে পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ করছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে। ফলে, শহরের সঙ্গে গ্রামের মানুষের বৈষম্য কমে এসেছে। আর মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই গ্রাম পছন্দ করে। কাজের সন্ধানে তারা শহরে এসেছিল। কিন্তু শহরে এখন নতুন কোনো কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। তাই মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এ বলা হয়েছে, পেশাগত জায়গায় শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারের মধ্যে এক-চতুর্থাংশের বেশি পরিবার নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। অথচ অন্য পেশায় থাকা মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও কম, গড়ে ২০ শতাংশ। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের ডিসেম্বরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কৃষি ছেড়েছে ১৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। বিভিন্ন হতাশার কারণে তারা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, আয়ের বৈষম্য, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজের ক্ষেত্র কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে কৃষি পেশা ছাড়ছে মানুষ। অনেক কৃষকই এখন ফসল ফলানোর চেয়ে অন্যের জমি চাষ করছে। বর্তমানে বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই যাচ্ছে কৃষিকাজে। শ্রমশক্তি জরিপ (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তথ্য অনুযায়ী, কৃষি পেশায় জড়িত ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার। অথচ এর আগের বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার। কৃষক তাদের পেশা ছেড়ে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে। বিবিএস এখন জিডিপির হিসাব প্রতি প্রান্তিকেই দিয়ে থাকে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এসে দেশের জিডিপি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৭। এ প্রান্তিকে এসে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি এত বেশি কমেছে যে, দেশের খাদ্য উৎপাদন নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। অথচ এর আগের অর্থাৎ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষির প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে দেশের কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে। ফলে, খাদ্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতা আরও বাড়ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে– আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে। ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো। ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে। গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় হয়। মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে সাধারণ চিত্র। গম উৎপাদন বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই বিধায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে প্রতিবছর। এক সময় সরিষা উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বর্তমানে এই ধারা রক্ষা করা যায়নি উচ্চফলনশীল বোরো ধান চাষের কারণে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অন্য পেশাগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর চেয়ে অনেক কম। বিশেষ করে যারা শিল্প খাতে কাজ করেন, তাদের খাবারের ঝুঁকি অন্যসব পেশার মধ্যে সবচেয়ে কম। শিল্পের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে ঘরে-বাইরে কিংবা দেশে-বিদেশে যে অভিবাসন চলছে, তা গবেষণার একটি ক্ষেত্র হতে পারে। তবে এটা বলাই ঠিক যে, সমাজের একটি রূপান্তর ঘটেছে এবং আগামীতে মানুষ ভাগ্যের অন্বেষণে এক খাত থেকে অন্য খাত কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করবেই। তাই দেশের সম্পদকে কিভাবে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ
সিটি ইউনিভার্সিটি