ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় করণীয়

জাস্টিন গোমেজ

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় করণীয়

বাংলা ভাষার ইতিহাস ১৩০০ বছরের পুরনো

বাংলা ভাষা তো মায়ের ভাষা, দেশের ভাষা। মায়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, দেশের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র গড়তে হলে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বাংলা ভাষা যেন আমাদের অবহেলার কারণে দুর্বল হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা চাই বিশ্বে নতুন মর্যাদার আসনে আসীন হোক মাতৃভাষা বাংলা। তা হলেই ভাষাসৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সার্থক হবে। দিকে দিকে বিকশিত হবে ও সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে মাতৃভাষা বাংলা

বাংলা ভাষার ইতিহাস ১৩০০ বছরের পুরনো। চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। বাংলার নবজাগরণ থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বিকাশে বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২-এর বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি অস্তিত্বের যোগসূত্র রয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের জন্য ভাষা আন্দোলন বাংলাকে নতুন জীবন দান করে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন শুধু নিছক ভাষার জন্য কোনো আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলন ছিল আমাদের মর্যাদার।

বাংলার মাটির টান থেকেই এই মর্যাদা ও অধিকারের স্পৃহা জাগরিত হয় ভাষা শহীদ আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকের মধ্যে। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে ভাষা শহীদরা ভাষার জন্য আত্মবলিদান করেছেন, আমরা তাঁদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁদের অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আমরা পেয়েছি গৌরবের বাংলা ভাষা। 
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিকে বলা হয় আমাদের চেতনার বাতিঘর। একুশের চেতনাই আমাদের মাতৃভাষাকে করেছেন মহান সম্পদ। একুশের চেতনাই স্বীকৃতি দিয়েছে মাতৃভাষার। তাই আমাদের জীবনে একুশ একটি অবিস্মরণীয়। একুশ আমাদের বায়ান্নর মহান অর্জন। একুশ আমাদের আবেগ। এই আবেগ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করে জাতীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে।

এই এগিয়ে যাওয়ার পথে এ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বরাবরই আমাদের স্মরণ করায়, আমরা আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই করেছি। এই চেতনাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাই আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, মায়ের ভাষার জন্য আমাদের ভাষাসৈনিকরা রক্ত দিয়েছেন। 
১৯৪৭ সালে যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল দেশের তরুণ সমাজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকেই রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ অনন্য এক দৃষ্টান্ত। এরপর তাঁর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করেছেন। তাঁর অঙ্গীকার, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বিকশিত হয়।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, বাংলা ভাষার ওপর কম অত্যাচার আসেনি। পাক সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াও এর বহু আগে বাংলা ভাষাকে কোণঠাসা করার প্রয়াস কম করা হয়নি। মুঘল আমলে ফারসি যখন রাজভাষা হিসেবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাংলা ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফারসি ভাষা বাংলা ভাষার ওপর চাপ দিতে থাকে। ফারসি ভাষা বাংলাকে গ্রাস করতে চায়। কিন্তু পারেনি। বেঁচে যায় বাংলা ভাষা।

মুঘলদের পরে ইংরেজরা এলে বাংলা ভাষার ওপর শুরু হয় নতুন অত্যাচার। তখনো বাংলা ভাষার বন্ধনকে উপেক্ষা করে অনেকে ভুলে যায় বাংলা ভাষার মহিমা। একদল সুবিধাভোগী ইংরেজি ভাষাকে সাদরে গ্রহণ করে। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তও বাংলা ভাষা ছেড়ে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চায় মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে মাতৃভাষার মর্ম বুঝতে পেরে তার সাহিত্য চর্চায় মোড় ঘোড়ালেন।

এ ছাড়াও যুগে যুগে একদল বাংলা ভাষা বিদ্বেষী মানুষ ছিলেন, যারা বাংলা ভাষাকে সুনজরে দেখতেন না। তারা হলেন মূলত পরগাছার মতো। তাদের ভাষাপ্রেম তো নেই-ই, দেশপ্রেমও নেই। দেশপ্রেম আর ভাষাপ্রেম পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার দেশপ্রেম থাকে, তার ভাষাপ্রেমও থাকে। যার দেশপ্রেম থাকে না, তার ভাষাপ্রেমও থাকে না।

তবে বাংলা ভাষাকে আরও মর্যাদাবান করে তুলতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। প্রয়োজনে আমরা নিশ্চয়ই বিদেশী ভাষা শিখব, কিন্তু কোনোভাবেই মায়ের ভাষাকে অবহেলা করে নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের মায়ের ভাষা যেন হারিয়ে না যায়, সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। বিলুপ্ত করা সহজ, বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। বাঙালি জাতি কঠিন কাজটি করতে কখনো পিছপা হয় না।

আমাদের নিয়মিত ভাষা চর্চা, প্রসার ও রক্ষাবিষয়ক আলোচনা করে ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা যত বেশি মাতৃভাষা ব্যবহার করব, তত এর প্রতিপত্তি বাড়বে। একদিন প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির শীর্ষে আরোহণ করবে এই মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার চর্চায় কঠিন শব্দ ও পরিভাষার জটিলতার অজুহাত দিলে হবে না। এগুলো থাকবে। প্রচুর চর্চার মাধ্যমে তা কেটে যাবে।

দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে বাংলা ভাষার সর্বস্তরে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা ভাষা তো মায়ের ভাষা, দেশের ভাষা। মায়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, দেশের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র গড়তে হলে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বাংলা ভাষা যেন আমাদের অবহেলার কারণে দুর্বল হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আমরা চাই বিশ্বে নতুন মর্যাদার আসনে আসীন হোক মাতৃভাষা বাংলা। তা হলেই ভাষাসৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সার্থক হবে। দিকে দিকে বিকশিত হবে ও সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে মাতৃভাষা বাংলা। একুশের চেতনা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে প্রজ্বলিত থাকুক চিরদিন। 
লেখক : সাংবাদিক

×