ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

গ্যাস সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

গ্যাস সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি

গ্যাস সংকট ও জ্বালানি

বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মাস কয়েক ধরে দিনের অধিকাংশ সময় সরকারি সরবরাহ লাইনে গ্যাস থাকে না। গভীর রাতে, কাকডাকা ভোরে চুলা-চিমনিতে টিকে থাকা টিমটিমে আগুনে চলে রান্নাবান্না। রাজধানী ঢাকাই শুধু নয়, গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে এক সময় প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার হিসেবে আলোচিত বাংলাদেশজুড়েই। গ্যাস সংকটের কারণে বাসাবাড়ি ছাড়াও উৎপাদনী শিল্প-কারখানার কাজ দিনে বন্ধ থাকছে। সিএনজি স্টেশন, পেট্রোল পাম্প সর্বত্রই একই অবস্থা।

এই অবস্থায় অনেক গ্রাহক বাধ্য হয়ে সরকারি সংস্থা তিতাসের পাশাপাশি সিলিন্ডার (এলপিজি) গ্যাস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। সিএনজি পাম্পে গ্যাসের চাপ কম থাকায় যারা গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার করেন তাদেরও দীর্ঘ লাইনে বসে থাকতে হচ্ছে। বাসাবাড়ির গ্রাহকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সরবরাহ লাইনে গ্যাসের সংকটে তাদের দৈনন্দিন জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাসের স্বল্পতা থাকায় শিল্পকারখানায় রেশনিং হচ্ছে।

রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো কিছু গ্যাস পেলেও স্থানীয়, বিশেষ করে এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না, যা শিল্পখাতের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। অপরদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবহেলা ও অযতেœ প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকটে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর হয়ে উঠেছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে অতিরিক্ত আমদানিও সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় আগামীতে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা এবং আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে।

তাদের মতে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক জ্বালানিসম্পদ গ্যাসের মজুত ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্বল। ফলে ভবিষ্যতে সামগ্রিক জ্বালানি পরিস্থিতি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভাবনাকে প্রচ-ভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। 
বিগত দেড় দশকে সরকার পর্যায়ক্রমে সারাদেশে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি বিশদ ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করলেও সে অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় দেশের জ্বালানি খাত ক্রমশ ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের মেয়াদে গ্যাস খাতের উন্নয়নে কিছু কাজ হয়েছে। যার সুফলের ওপর এতদিন ধরে সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা- চলেছে। এরপর এই খাতের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি।

এখন আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাওয়ায় বাংলাদেশের জ্বালানি খাতও ক্রমশ জটিল অবস্থায় নিপতিত হচ্ছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, শিল্প, সার, গৃহস্থালি, সিএনজিসহ ৭টি সেক্টরে গ্যাসের মোট চাহিদা ৩,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দেশে দৈনিক সরবরাহ ২৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা গত সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত অক্টোবর থেকে শীত শুরু হওয়ায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে।

পাশাপাশি কমেছে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদাও। তারপরও দেশজুড়ে তীব্র গ্যাসের সংকট চলছে, যা বাংলাদেশের গ্যাসের মজুত কমে যাওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে। অথচ দুটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনেক আগেই বলেছে, বাংলাদেশের মাটির নিচে অন্তত ৩২ ও ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে, যা দিয়ে অন্তত ৩০ বছরের গ্যাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। উত্তোলন করা কিছুটা কঠিন হলেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো সরকারই স্পষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেনি।
গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রতিবছর শীতকাল এলেই প্রাকৃতিক গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ সময় নানা মহল থেকে উদ্বেগ-আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, যা মাস কয়েক পরে স্তিমিত হয়ে এক সময় চলে যায় সবার আড়ালে। মনে রাখা প্রয়োজন, দীর্ঘদিন প্রাকৃতিক গ্যাসের সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাই শুধু নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে জরুরিভিত্তিতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র ও কূপ আবিষ্কার করতে হবে। গ্যাসের সদ্ব্যবহারে মনোযোগী হতে হবে, অথবা নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যেহেতু গ্যাসকূপ আবিষ্কার করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল, সেহেতু বিকল্প পথ আমাদের অবশ্যই নিতে হবে। এক্ষেত্রে ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কমপক্ষে ৪০টি কূপের ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায়। সেগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব।

কিন্তু নানা কারণে তাও হচ্ছে না। নতুন কূপ আবিষ্কার না হলে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের পর প্রায় পুরোপুরি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত হতে হবে। 
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, জরুরিভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের ৭ শতাংশ হারাবে। 
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানির নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ধরন এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও ব্যয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। ২০২১ সালের হিসাবে দেশের ১৪৬টি পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। যার মধ্যে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন হচ্ছে, যা সর্বমোট সক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ।

অথচ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের মোট জমির ৪ শতাংশ ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে দেশের সম্পূর্ণ জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে প্রণোদনাসহ সোলার প্যানেল, প্রস্তুতের উপাদান, চার্জ কন্ট্রোলার, ইনভার্টার, এলইডি লাইট, সৌরচালিত বাতি ও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে শুল্ক অব্যাহতি দিচ্ছে। কিন্তু বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কার্যকরভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল।

সৌর জ্বালানির বিপুল সুযোগ থাকায় নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনার বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান ৪১তম। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাস, হাইড্রো, জিওথারমাল, টাইডাল ওয়েব প্রভৃতিকে কাজে লাগানোর জন্য বেসরকারি পর্যায়ে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ এখনো গড়ে ওঠেনি। বড় পুঁজির মালিকেরা নগদ লাভ পাওয়ার আশায় এলপিজি গ্যাস আমদানি ও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতেই সরকার নাজেহাল হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে কয়লা ও এলএনজির মূল্যের অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। এসব সত্ত্বেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগের পরিবর্তে ঘাটতি মেটাতে কয়লা ও এলএনজি আমদানিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে সবকিছু চলছে তাতে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটানো দেশের জন্য হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 
বাংলাদেশের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে উত্তরণ এই কারণে জরুরি যে, এতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অর্থ সাশ্রয় হবে, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, মানুষ সুস্থ জীবনের সুবিধা পাবে। কেবল ২ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি স্থাপন করা হলে বছরে বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানি বাবদ ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব।

হিসাব করে দেখা গেছে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ অনুযায়ী সৌরশক্তির প্রসার ঘটলে ২০২২-২৪ সালের মধ্যে এলএনজির চাহিদা ২৫ শতাংশ কমে যেত এবং ২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হতো। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে প্রতিবছর অতিরিক্ত ৬৮৪ মেগাওয়াট বিদু্যুৎ উৎপাদন করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এই লক্ষ্য অর্জন থেকে অনেক পিছিয়ে আছি।

জ্বালানিসম্পদ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও লক্ষ্যের ঘাটতি নেই; কিন্তু কার্যকর উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সরকারের উচিত জ্বালানির প্রবাহ ও বিতরণের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কয়লাভিত্তিক ও কুইক রেন্টালের মতো ক্ষতিকর প্রকল্পগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস তৈরি ও প্রকল্প বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করবে। 

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×