ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতীয় শিক্ষাক্রম

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতীয় শিক্ষাক্রম

স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ তথা

স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ তথা নাগরিক হয়রানিবিহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া। যেখানে ভোগান্তি ছাড়া স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে এবং কর্তব্য পালনের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হবে। একটি রাষ্ট্রকে স্মার্ট রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রধান উপকরণ হলো দক্ষ মানবসম্পদ। বিশ্বকে নেতৃত্বদানকারী উন্নত রাষ্ট্রগুলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সফল হয়েছে বলেই কেবল তারা স্মার্ট জাতি।

একটি জাতিকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে প্রথমেই শিক্ষার বিষয়টি আসে। সুশিক্ষিত, স্মার্ট, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে মানসম্মত এবং যুগোপযোগী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার লক্ষ্যে ২০২২ সালে প্রণীত হয় শিক্ষানীতির একটি নতুন রূপরেখা। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়নের পর তার ভিত্তিতে ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করে ২০১৩ সাল থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক রচনার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করা হয়। ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিগত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালিতে ব্যাপকভাবে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। কর্মক্ষেত্র ও কর্মধারায় পরিবর্তনের ফলে মনোজগতেও এসেছে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে খাপ খাওয়ানোর জন্য শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী করা আবশ্যক। তাছাড়া অনাগত পেশা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা।

শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে- ১) শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক ও আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ২) বিষয় এবং পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে দক্ষতা এবং যোগ্যতায় গুরুত্বারোপ। ৩) গভীর শিখন ও তার প্রয়োগে গুরুত্ব প্রদান। ৩) মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনে অগ্রাধিকার প্রদান করা। ৪) খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিখনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা। ৫) নির্দিষ্ট দিনের শিখনকাজ যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শেষ হয়, সে ধরনের শিখন কার্যক্রম পরিচালনা এবং আনন্দময় কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে বাড়ির কাজের চাপ কমানো। ৬) নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতার মূল্যায়ন ও সনদপ্রাপ্তির প্রতি গুরুত্বারোপ। ৭) জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা। 
শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট হিসেবে যেসব বিষয়কে আমলে নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ১) চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে জীবন-জীবিকার দ্রুত পরিবর্তন। যেখানে প্রচলিত পেশার তিন ভাগের দুই ভাগ ২০৩০ সালের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক শিক্ষায় আছে, তারা কর্মজগতে প্রবেশ করে যে কাজ করবে, তা এখনো অজানা। ২) কোভিডের মতো মহামারি, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অভিবাসন, দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাত, প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, জীবিকার পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে ভৌগোলিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের জীবনধারা ও মনোসামাজিক জগতে দ্রুত পরিবর্তন। ৩) এসডিজির লক্ষ্যমাত্র অর্জন। ৪) স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। ৫) প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রমের নিরবচ্ছিন্ন সামঞ্জস্য বিধান।

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর রূপকল্প মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমী, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা। রূপকল্প অর্জনে প্রয়োজন সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন। একটি কার্যকর পরিকল্পনা ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নই এ রূপকল্প অর্জন নিশ্চিত করতে পারে। রূপকল্প বাস্তবায়নের অভিলক্ষ্যগুলো হলো- ১) সব শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে কার্যকর ও নমনীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন। ২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর বিকাশ ও উৎকর্ষের সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। ৩) প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি প্রদান। ৪) সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। ৫) শিক্ষা ব্যবস্থার সব পর্যায়ে দায়িত্বশীল, স্বপ্রোণিত, দক্ষ ও পেশাদার জনশক্তি নিয়োগ। 
জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এ যোগ্যতা বলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া সব স্তরের শিক্ষার্থীদের অর্জনের জন্য ১০টি মূল যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১) অন্যের মতামত ও অবস্থানকে সম্মান ও অনুধাবন করে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিজের ভাব, মতামত যথাযথ মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করতে পারা। ২) যে কোনো ইস্যুতে সূক্ষ্ম চিন্তার মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে সবার জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারা। ৩) ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে সম্মান করে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা প্রদর্শনপূর্বক বিশ্ব নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করা। ৪) সমস্যার প্রক্ষেপণ, দ্রুত অনুধাবন, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ তাৎপর্য বিবেচনা করে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে ও সমাধান করতে পারা। ৫) পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্মান ও সম্প্রীতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ৬) নতুন দৃষ্টিকোণ, ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন পথ, কৌশল ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করে শৈল্পিকভাবে তা উপস্থান এবং জাতীয় ও বিশ্বকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারা। ৭) নিজেদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে নিজ অবস্থান ও ভূমিকা জেনে ঝুঁকিহীন নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি করতে এবং বজায় রাখতে পারা। ৮) প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ঝুঁকি মোকাবিলা এবং মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন এবং জীবিকার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারা। ৯) পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে দৈনন্দিন উদ্ভূত সমস্যা গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে সমাধান করতে পারা। ১০) ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন এবং শুদ্ধাচার অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারা।

প্রচলিত ও পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- এখানে মতবাদ, দর্শন, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এছাড়াও মূল্যায়নের পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিখন অর্জন আগের মতো কাগজ-কলমে আনুষ্ঠানকিভাবে মূল্যায়ন না করে তার অভিজ্ঞতা, আচরণ, কর্মদক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে করা হবে। এক্ষেত্রে গাণিতিক নম্বর না দিয়ে জ্যামিতিক প্রতীক তথাÑ চতুর্ভুজ, বৃত্ত, ত্রিভুজ দেওয়া হবে। বার্ষিক ফলের ভিত্তিতে রোল নম্বর না দিয়ে একটি ইউনিক আইডি নম্বর দেওয়া, যেটা একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। 
শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী নয়, আরও অনেকে জড়িত থাকেন। শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় জড়িত পক্ষগুলো হলো- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, পাঠের পরিবেশ ইত্যাদি। শিক্ষা কার্যক্রম এখন আর শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিষয়বস্তুর চাহিদানুযায়ী প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ের বাইরেও যেতে হবে। শিক্ষাদান পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘পেডাগোজি’, যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ শিক্ষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।

একজন পেডাগোজিস্টের আধুনিক শিখন-শেখানো দক্ষতা ও কৌশলসমূহ আয়ত্ত করতে হবে এবং সেগুলো সফলভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের সামর্থ্য থাকতে হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এ শিখন-শেখানো কৌশলের যে দিকগুলোর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে, তা হলোÑ ১) প্রেক্ষাপটভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক। ২) হাতে-কলমে শিখন, প্রকল্প এবং সমস্যাভিত্তিক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখন, অনুসন্ধানভিত্তিক শিখন, স্বপ্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ। ৩) অনলাইন ও মিশ্র শিখন। ৪) শিক্ষক-  সহায়তাকারী এবং শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। ৫) শিখন প্রক্রিয়ায় বিষয়সংশ্লিষ্ট কোনো বাস্তব জীবনধর্মী সমস্যা নির্ধারণ করে তা সমাধানের উপায় নির্ধারণ এবং তা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিতকরণ। ৬) শিখন পরিবেশ সহায়তামূলক, একীভূত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী। ৭) শিখন পরিবেশ শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক ও সহযোগিতামূলক। 
কোনো বিষয়ের শিখন উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীরা কতটুকু আয়ত্ত করতে পেরেছে তা নিরূপণের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থী সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, বিচার-বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াই মূল্যায়ন। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো হলো- ১) মূল্যায়নকে কেবল শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশের মূল্যায়ন ও সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর শিখনের মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ২) সব ধরনের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হবে যোগ্যতা এবং পারদর্শিতা।

শিক্ষাক্রমে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের যেসব বিষয় অনুসরণ করা হবে সেগুলো হলো- ১) যোগ্যতার মূল্যায়ন নিশ্চিতকরণ। ২) শিখনের জন্য শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্বারোপ। ৩) স্বমূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, মূল্যায়নে অভিভাবক ও সমাজের সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ। ৪) মুখস্থনির্ভর সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস। ৫) শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের ধাাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা। 
শিক্ষাক্রমে ইনক্লুশন হলো- ১) শিখনে শিশুর মধ্যে সমস্যা না খুঁজে, শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো ধরনের দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থী শিখতে পারছে না, তা চিহ্নিত করা। ২) শিক্ষার্থীর মধ্যে সমস্যা খোঁজার পরিবর্তে শিক্ষা ব্যবস্থা ও কাঠামোর প্রতিবন্ধকতাকে শনাক্ত ও দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ। ৩) লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিবেচনায় নিয়ে শিশুর সামর্থ্য, চাহিদা ও বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র্যময়তা প্রস্ফুটিত করার উদ্যোগ নেওয়া। ৪) শিক্ষাক্রমে নমনীয়তার মাধ্যমে ভিন্নভাবে সমর্থ শিশু ও তৃতীয় লিঙ্গ এবং অতি মেধাবী শিশুদের শিখন চাহিদা, সক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া।

শিক্ষাক্রম রূপরেখায় প্রস্তাবিত মূল পরিবর্তনগুলো হলো- ১) সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন প্রবর্তন। ২) দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবার জন্য ১০টি বিষয় (প্রচলিত মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না)। ২) অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম বিদ্যালয়, পরিবার ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন। ৩) শিখনকালীন মূল্যায়ন। ৪) পরীক্ষার চাপ কমানোর জন্য একাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে উচ্চমাধ্যমিক সমাপনী মূল্যায়ন। ৫) নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি অকুপেশনের ওপর পেশাদারি দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক। 
জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ কী ভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা এর রূপরেখায় স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর জন্য যা করতে হবে, তা হলো- ১) সংশ্লিষ্টদের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর রূপরেখা ভালোভাবে পড়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা। ২) জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর রূপকল্প-‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমী, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা’-এ বাক্যের প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা। ৩) জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর দর্শন ভালোভাবে বুঝতে পারা। ৪) পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতা অর্জন করা। এ জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা থাকা। ৫) জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এ বর্ণিত ১০টি কোর কম্পিটেন্সি বারবার পড়ে নিজে বা দলগতভাবে বাস্তবায়নের সমস্যা চিহ্নিত করে তা ব্যক্তিগত বা দলগত অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। ৬) জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিভাকদের যুক্ত করে তাদের সহযোগিতা নেওয়া। ৭) সরকার প্রদত্ত সর্বশেষ মূল্যায়ন দলিল সংগ্রহ করে সেটি অনুসরণ করে বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। ৮) বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। ৯) শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সম্মানজনক বেতন প্রদান করা। ১০) নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অর্থ সরবরাহ করা। 
বর্তমান বিশ্ব উত্তম সনদধারীর পরিবর্তে যোগ্য ও দক্ষ কর্মী খোঁজে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী কর্মকৌশল জনগোষ্ঠী তৈরিতে বর্তমান শিক্ষাক্রম যৌক্তিক। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞাননির্ভর শিক্ষাক্রম অনুশীলন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত জ্ঞান লাভ করলেও দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে পরিবর্তন শুধু দেশে নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডল বিবেচনায় নিতে হবে। যুগোপযোগী ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন সহজ কাজ নয়।

প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম এবং  তার আলোকে লিখিত পাঠ্যপুস্তকে কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা সংশোধনের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনা হচ্ছেÑ ‘সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য’ এ পরিবর্তন অপরিহার্য। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার বিকল্প নেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×